খেলা

অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা কমছে, বাড়ছে দুরারোগ্য ব্যাধি

<![CDATA[

মানুষের নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম বড় কারণ ব্যাকটেরিয়া। এসব ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসে বিশ্ববাসীর জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কার। তবে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মের তোয়াক্কা না করে অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত-অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার থেকে উদ্ভব হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী নানা ব্যাকটেরিয়ার। অর্থাৎ এ জাতীয় ওষুধের কার্যকরিতা কমছে, যা কেড়ে নিচ্ছে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ।

চিকিৎসকরা বলছেন, ওষুধগুলো সাধারণত ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার প্রাচীরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সেগুলোকে নিস্ক্রিয় করে দেয়। তবে নিয়ম না মেনে কিংবা প্রয়োজন ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে এক জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করলে, ব্যাকটেরিয়াগুলো নিজেদের গঠনগত পরিবর্তন এনে নির্দিষ্ট সেই ওষুধকে অকার্যকর করে ফেলতে পারে।

মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানসেটের তথ্য অনুসারে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু থেকে সৃষ্ট নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১৯ সালে ১০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গুরুতর সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রথম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজে আসেনি।

অণুজীব-বিরোধী প্রতিরোধ্যতা বা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত অন্যতম। এ পরিস্থিতি দিন দিন কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠছে সেই চিত্র উঠে এসেছে সম্প্রতি প্রকাশিত নতুন এক সরকারি প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার কারণে ভারতে প্রতিবছর প্রায় ৬০ হাজার নবজাতকের মৃত্যু হয়।

পাঁচটি প্রধান ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ-জীবাণু মোকাবিলায় কোন অ্যান্টিবায়োটিক সবচেয়ে কার্যকর হবে তা খুঁজে বের করার জন্য মহারাষ্ট্রের কস্তুরবা হাসপাতালে করা পরীক্ষায় দেখা গেছে, গুটি কয়েক ওষুধই এক্ষেত্রে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।

এসব রোগ-জীবাণুর মধ্যে রয়েছে এশেরিকিয়া কোলাই বা ই. কোলাই (সাধারণত দূষিত খাবার খাওয়ার পরে মানুষ এবং অন্য প্রাণীর অন্ত্রে পাওয়া যায়), ক্লেবসিয়েলা নিউমোনিয়া (যা ফুসফুসকে সংক্রমিত করে নিউমোনিয়া ঘটাতে পারে এবং এর থেকে মেনিনজাইটিস হতে পারে) এবং খাদ্য-বাহিত প্রাণঘাতী ব্যাকটেরিয়া স্ট্যাফিলোকক্কাস অরিয়াস।

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রধান কিছু অ্যান্টিবায়োটিক এসব ব্যাকটেরিয়া থেকে সৃষ্ট সংক্রমণের চিকিৎসায় ১৫ শতাংশেরও কম কার্যকর। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো অ্যাকিনেটোব্যাক্টর বাউমানি নামের অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া, যা ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে লাইফ সাপোর্টে থাকা রোগীদের ফুসফুসে আক্রমণ করে।

আরও পড়ুন: মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা কতটা ভাবি?

কস্তুরবা হাসপাতালের চিকিৎসক এসপি কলন্ত্রী বলেন, আমাদের বেশিরভাগ রোগী উচ্চতর অ্যান্টিবায়োটিকের খরচ বহন করতে পারেন না। ফলে তারা যখন আইসিইউতে ভেন্টিলেটর-সম্পর্কিত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন, তখন তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে।

আইসিএমআর-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিষয়গুলো এতটাই উদ্বেগজনক যে ভারতে মাত্র একটি ব্যাকটেরিয়া থেকে সৃষ্ট নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগীর ৪৩ শতাংশকে ২০২১ সালে অ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া গেছে। বলা হচ্ছে, ২০২১ সাল পর্যন্ত আগের ছয় বছরে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা কমেছে প্রায় ৬৫ শতাংশ।

কলকাতার এএমআরআই হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ শাস্বতী সিনহা জানান, পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে সেখানকার আইসিইউতে ১০ জনের মধ্যে ছয় জন রোগীর ওষুধ-প্রতিরোধী সংক্রমণ পাওয়া যায়।

তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি সত্যিই উদ্বেগজনক। আমরা এমন এক পর্যায়ে এসেছি, যেখানে এ ধরনের (ওষুধ-প্রতিরোধী সংক্রমণে আক্রান্ত) রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে বিকল্প তেমন কোনো পথ থাকে না।’

স্থানীয় চিকিৎসকরা বলছেন, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া গ্রাম এবং ছোট শহরের বাইরের রোগীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ছে, যাদের নিউমোনিয়া এবং মূত্রনালীর সংক্রমণ রয়েছে। বেশিরভাগ রোগী প্রেসক্রিপশন সঙ্গে না রাখায় এবং আগে সেবন করা ওষুধের নাম মনে করতে না পারায়, অতীতে তারা কী ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেছেন তা নিরুপণ করে যথাযথ চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনায় পড়ছেন চিকিৎসকরা।

আরও পড়ুন: মানসিক রোগের চিকিৎসায় বাধাগুলো কী?

চিকিৎসক এসপি কলন্ত্রী বলেন, এ ধরনের রোগীদের চিকিৎসা দেয়া একটি ‘অগ্নিপরীক্ষা’। এমন পরিস্থিতিতে রোগীদের নতুন করে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হলে উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি হতে পারে।

এছাড়া জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারতের অনেক চিকিৎসক কোনো কিছু বিবেচনা না করেই রোগীদের বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরামর্শ দিচ্ছেন। তারা বলছেন, অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ফ্লু বা সাধারণ জ্বর-সর্দির মতো অসুস্থতা নিরাময় করতে পারে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ নিয়ে মানুষের সচেতনতার অভাব রয়েছে। আর অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণ সম্পর্কে রয়েছে জ্ঞানের অভাব। অনেক সময় শিক্ষিতরাও অসুস্থ হলে অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করার জন্য চিকিৎসকদের চাপ দেন।

আইসিএমআর-এর বিজ্ঞনী এবং গবেষণার প্রধান লেখক ডা. কামিনী ওয়ালিয়া বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিকের দাম কমে যাওয়ায় এবং ডায়াগনস্টিকস ব্যয়বহুল হয়ে ওঠায় চিকিৎসকরা অনেক সময় জরুরি পরীক্ষা-নীরিক্ষা ছাড়াই ওষুধ লিখে দেন। চিকিৎসকরা কখনও কখনও নিশ্চিতও থাকেন না যে তারা আসলে কীসের চিকিৎসা করছেন।’

বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যবিষয়ক থিংক ট্যাংক ওয়ান হেলথ ট্রাস্টের পরিচালক রামানন লক্ষ্মীনারায়ণের মতে,  অন্য অনেক দেশের মতো অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণ ভারতের জন্যও উদ্বেগের বড় বিষয়। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের অভাব এবং প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনীয় সেবন সংক্রামক রোগ বাড়িয়ে তুলছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংকট নিরসনে ডায়াগনস্টিক ল্যাবগুলোতে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে এবং ক্রমবর্ধমান হুমকি মোকাবিলায় পরীক্ষার ভিত্তিতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের বিষয়ে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সেটি করা না গেলে, অদূর ভবিষ্যতে মহামারি আকার ধারণ করতে পারে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ।

লেখক: সৌতিক বিশ্বাস। বিবিসি থেকে অনূদিত

]]>

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
error: Content is protected !!