আবার ঘৃণার শিকার কৃষ্ণাঙ্গ, কিন্তু কেন?
<![CDATA[
বিশ্বে নিজেদের যারা মানবতা রক্ষার কান্ডারি বলে মনে করে তাদের নিজভূমেই যখন মানবতার চরম অপমান হয় তখন সেটা সর্ষের মধ্যে ভূতের মতোই মনে হয়। বলছি টাইয়ার নিকোলাসের কথা। টাইয়ার নিকোলাস এখন বিশ্বব্যাপী পরিচিত একটি নাম। যেমন হয়ে উঠেছিলেন জর্জ ফ্লয়েড। বর্ণবাদী ঘৃণার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটলো আবার টাইয়ার নিকোলাসকে হত্যার মাধ্যমে।
সম্প্রতি তাকে ভয়াবহভাবে প্রহারের ভিডিও প্রকাশ হওয়ায় স্তম্ভিত ও ক্ষুব্ধ যুক্তরাষ্ট্রের অসংখ্য মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশি প্রহারে নিহত টাইয়ার নিকোলাসের ওপর চলা ভয়াবহ প্রহারের ভিডিওটি শুক্রবার প্রকাশিত হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, ২৯ বছর বয়সি কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ টাইয়ার নিকোলাসকে রাস্তায় ফেলে ভয়াবহভাবে পেটানো হচ্ছে। প্রহারের এক পর্যায়ে নিকোলাস চিৎকার করে তার মাকে ডাকেন। বাড়ি থেকে মাত্র ৮০ গজ দূরে এই ঘটনার শিকার হন নিকোলাস। ভিডিওতে দেখা যায়, কিভাবে তার নাকে মুখে লাথি মারা হচ্ছে। কিভাবে ভয়াবহ প্রহারের মুখে কাতরভাবে আর্তনাদ করছেন নিকোলাস। অথচ কেন তার প্রতি এই আক্রোশ সেটাও বোধগম্য নয়। নিকোলাস কি কোনো গ্যাং লর্ড বা মাফিয়া লর্ড ছিলেন? তাকে কি কোনো অপরাধস্থল থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল? কোনটাই নয়। ৭ জানুয়ারি টেনেসি রাজ্যের মেমফিসে রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় পুলিশ নিকোলাসের গাড়িকে থামায়। তার বিরুদ্ধে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর অভিযোগ আনা হয়। যদিও পরে এই অভিযোগের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি পুলিশ। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে তাকে মাটিতে ফেলে ভয়াবহভাবে প্রহার করা হয়। পরে হাসপাতালে নিকোলাসের মৃত্যু হয়।
নিকোলাস কোনো অপরাধী ছিলেন না। তিনি ফেডেক্স কোম্পানির কর্মী এবং চার বছর বয়সি এক সন্তানের পিতা ছিলেন। তার একটি অসুখ ছিল। এই অসুখের কারণে তিনি ছিলেন অতিশয় কৃশ। ছয় ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতার নিকোলাসের ওজন ছিল মাত্র ছেষট্টি কেজি। ভয়াবহ ওই শারিরীক নির্যাতনের এক অসহায় শিকার ছিলেন নিকোলাস। পুলিশ প্রথমে তার চোখে মুখে পেপার স্প্রে মারে। তারপর প্রচণ্ড আক্রোশে মারতে থাকে। এটাকে সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডারের তালিকায় ফেলা হয়েছে। প্রহারের ভিডিও প্রকাশের পর মেমফিস, নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি শহরে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। ভিডিও ফুটেজ দেখে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, তিনি নিজেকে ‘অপমানিত এবং গভীর যন্ত্রণাকাতর’ বলে মনে করছেন। বিভিন্ন স্থানের পুলিশ প্রধানসহ অনেক সংস্থা আফ্রো-আমেরিকান নিকোলাসের মৃত্যুর নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু এমন ঘটনা কি এই প্রথম ঘটলো? মনে পড়ছে মৃত্যুর আগে জর্জ ফ্লয়েডের সেই কাতর উক্তি, ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না।’
এই উক্তিতে ধ্বনিত হচ্ছে মানবতার কান্না। এই কান্নার রং কি কালো? এই কান্না কি ভেসে আসছে আফ্রিকার অন্তঃস্থল থেকে? সেই যখন গাম্বিয়ার কিশোর কুন্তা কিন্তেকে পশুর মতো খাঁচায় বন্দী করে নিয়ে আসা হয়েছিল তার জন্মভূমির উদার প্রান্তর ও সবুজ শস্যক্ষেত থেকে। স্বাধীন মানুষকে অপহরণ, তাকে শিকলে বেঁধে জাহাজবোঝাই করে ভেড়ার পালের মতো নিয়ে আসা হয় এক নতুন দেশে। সেখানে তার একটাই পরিচয়-দাস। পালটে ফেলা হয় তার নাম। সে আর গ্রামের প্রাণবন্ত ছেলে কুন্তা কিন্তে নয়। তার নাম টোবি। সে একজন ক্রীতদাস। মালিক বদল হলে কিংবা চাইলে আবারও বদলে যেতে পারে তার নাম। তাকে যে কোন শ্রমে বাধ্য করা যায়। রাজি না হলে বা মালিকের ইচ্ছা হলে অনায়াসে উপড়ে নেয়া যায় তার চোখ, ফুটন্ত তেলে জীবন্ত সিদ্ধ করা যায় তাকে, তার দেহে গরম লোহা দিয়ে চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয়। তার স্ত্রী, সন্তান বলে কিছু নেই। স্টাড হর্সের মতো তাকে বাধ্য করা হয় তারই মতো অন্য এক কৃষ্ণাঙ্গ নারীর সঙ্গে সঙ্গমে।
সেই নারীরও একটিই পরিচয় ‘ক্রীতদাসী’। আর তাদের জন্ম নেয়া সন্তানগুলোকে পশুর মতোই বিক্রি করে দেয়া হয় দাসহাটে। এই হচ্ছে বর্ণবাদের আসল চেহারা। যেখানে একজন মানুষ শুধুমাত্র তার গায়ের রঙের জন্য পশু এবং প্রয়োজনে পশুর চেয়ে অনেক বেশি ঘৃণ্য হিসেবে বিবেচিত। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত অ্যালেক্স হ্যালির ‘রুটস: দ্য সাগা অফ অ্যান আ্যামেরিকান ফ্যামিলি’ উপন্যাসে মানবতার সেই দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। উপন্যাসটি প্রকাশের পর বিশ্ব সাহিত্যভুবন স্তব্ধ হয়ে প্রত্যক্ষ করে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে আফ্রিকা থেকে বন্দী করে আনা স্বাধীন মানুষদের দাস হয়ে যাওয়ার অবিশ্বাস্য উপাখ্যান। তাদের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতনের দলিল এই উপন্যাসটি। অ্যালেক্স হ্যালির পরিবারের নিজস্ব ইতিহাস এই কাহিনী। এখানে আফ্রো-আমেরিকান পরিবারের প্রজন্মান্তরের কাহিনী।
আরও পড়ুন: ‘আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম’
উপন্যাসটি বিশেষ পুলিৎজার তো জয় করেই, সেইসঙ্গে এটি আমেরিকান সাহিত্যের একটি ক্ল্যাসিক হিসেবেও গণ্য।
আচ্ছা এতো গেল অতীতের ঘটনা। কিন্তু বিংশ শতকেই কি পালটে গিয়েছিল সব? মনে পড়ছে হারপার লির কালজয়ী উপন্যাস ‘টু কিল আ মকিং বার্ড’ এর কথা। এটাও অনেকটা বাস্তব ঘটনার ভিত্তিতেই লেখা। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসে বলা হয়েছে ১৯৩০ দশকের একটি ছোট্ট, আপাত শান্তিপূর্ণ কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দায় কিছুটা বিপর্যস্ত মফস্বল শহরের গল্প। আপাত শান্তিপূর্ণ কারণ এ শহরে শ্বেতাঙ্গরা বেশ শান্তিতেই থাকে। আর কৃষ্ণাঙ্গ? তারা আবার মানুষ নাকি? এ শহরে এক শ্বেতাঙ্গ তরুণী ধর্ষণের অভিযোগ আনে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক টম রবিনসনের বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত যেখানে কৃষ্ণাঙ্গ সেখানে বিচারের আগেই যে সে দোষী হয়ে পড়বে, সাদা বাসিন্দাদের জনরোষের শিকার হবে সেকথা তো বলাই বাহুল্য। কৃষ্ণাঙ্গ টমের পক্ষে দাঁড়ানো আপোষহীন আইনজীবী অ্যাটিকাস ফিনচের উপরেও সেই ঘৃণার বর্ষণ ঘটে। যদিও টম ছিল নির্দোষ তবুও তাকে পাঠানো হয় কারাগারে। সেখান থেকে পালাতে গেলে তাকে গুলি করে হত্যাও করা হয়। পলায়নপর বন্দী যদি হয় শ্বেতাঙ্গ তাহলে তার পায়ে গুলি করা হয় আর বন্দী যদি কৃষ্ণাঙ্গ হয় তাহলে তাকে গুলি করা হবে প্রাণ হরণের জন্যই।
শেষ পর্যন্ত অ্যাটিকাস ফিনচ অবশ্য তার আইনি লড়াই চালিয়ে যান এবং মৃত টম রবিনসনকে নির্দোষ প্রমাণিত করে বর্ণবাদের কুৎসিত চেহারাটা উন্মোচন করেন সকল বাধাবিপত্তি ও পরিবারের ওপর হামলা সত্ত্বেও। অ্যাটিকাস ফিনচ হয়ে ওঠেন মানবতাবাদী বর্ণবাদবিরোধী মানুষের প্রতীক।ষাট ও সত্তরের দশকেও যুক্তরাষ্ট্রের অনেক স্টেটে আফ্রো-আমেরিকান বা কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য সূর্যাস্ত আইন জারি ছিল।এই আইনের বদৌলতে কোন কৃষ্ণাঙ্গ সূর্যাস্তের পর শহরের প্রাণকেন্দ্র, অভিজাত আবাসিক এলাকা, নির্ধারিত এলাকায় থাকতে পারবে না। তাকে কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে থাকতে হবে। তাদের জন্য আলাদা স্কুল,বিভিন্ন স্থানে আলাদা জলের কলের ব্যবস্থাও ছিল। `ডগস অ্যান্ড ব্ল্যাকস আর নট অ্যালাউড’ কোনো মধ্যযুগের গল্প নয়। বরং সুসভ্য বিশ শতকের রূঢ় বাস্তব। পঞ্চাশের দশকে আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটে কৃষ্ণাঙ্গ কিশোর, তরুণকে বিনা অপরাধে শুধু কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার কারণে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটে পুলিশের হাতেই। সপ্তদশ, অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে আফ্রিকা থেকে শিশু কিশোর ও যুববয়সী অসংখ্য নর-নারীকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় আমেরিকায়। তাদের দাস হিসেবে আটকে রেখে জোর করে শ্রমিক বানানো হয়। এরা মূলত ছিলেন কৃষিদাস এবং গৃহদাস। আর স্বাধীন মানুষকে গোলামির জিঞ্জির পরানোর এই ব্যবস্থাটি ছিল সম্পূর্ণ বৈধ ও আইনসিদ্ধ।
এমনকি আমেরিকা স্বাধীন হওয়ার পরও তাদের দাসত্ব ঘোচেনি। সভ্যতার কান্ডারি বলে বিবেচিত তথাকথিত সুসভ্য শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা এই দাসপ্রথাকে বৈধতা দিয়েছে এই সেদিন পর্যন্ত। আমেরিকার গৃহযুদ্ধর মূল কারণও ছিল এই দাসপ্রথার প্রশ্নেই। বর্তমানে আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয় ‘আফ্রো-আমেরিকান’ শব্দ। ইতিহাসের নির্মম কৌতুক হলো, আফ্রো-আমেরিকান, নেটিভ-আমেরিকান (আদিবাসী আমেরিকান, যাদের আগে বলা হতো রেড ইন্ডিয়ান) এবং এশীয়-আমেরিকান থাকলেও ইউরো-আমেরিকান বলে কোনো শব্দ নেই। কারণ ধরেই নেওয়া হচ্ছে আমেরিকার অধিবাসী মানেই শ্বেতাঙ্গ। যে আমেরিকান নাগরিকরা নাৎসি বাহিনীর প্রধান অ্যাডলফ হিটলারের ইহুদি নিধন ও বিরোধিতাকে বর্ণবাদী বা রেসিস্ট বলে নিন্দায় মুখর তাদেরই দেশে কিন্তু ক্লু ক্লুকস ক্ল্যানের মতো কৃষ্ণাঙ্গ হত্যাকারী ও চরমপন্থী বর্ণবাদী সংগঠন সগৌরবে বিরাজ করেছে। এমনকি এই ধরনের সংগঠন গোপনে তাদের কার্যক্রম চালিয়েছে গত শতক পর্যন্ত।
আরও পড়ুন: এ কীসের ছায়া গ্রন্থমেলায়!
১৯৬৮ সালে মানবতাবাদী মহান নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে (মাত্র ৩৯ বছর বয়সে) গুলি করে হত্যা আর আজকের টাইয়ার নিকোলাস হত্যায় খুব বেশি পার্থক্য নেই। এক জাতি বা বর্ণের মানুষ অন্য বর্ণের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এই ভ্রান্ত ও কুৎসিত চিন্তাধারাটাই কি পরিত্যক্ত হওয়া কাম্য ছিল না অনেক বছর আগে? জর্জ ফ্লয়েডের ঘাড়ে পা চেপে তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা, টাইয়ার নিকোলাসকে পিটিয়ে হত্যা প্রমাণ করে ‘উই আর সেম বোট ব্রাদার’ একটি ক্লিশে মিথ মাত্র। বাস্তবে আমেরিকা এখনও বর্ণবাদের শ্বাসযুক্ত ও বাইরে মানবতার খোসায় মোড়া একটি বিষাক্ত ফল। এই বিষবৃক্ষ গণমানস থেকে চিরতরে উৎপাটনে অনেক মার্টিন লুথার কিং, হারপার লি, অনেক অ্যাটিকাস ফিনচ চাই।
]]>