বাংলাদেশ

ইউক্রেনের জনসংখ্যার ভবিষ্যৎ অন্ধকার

<![CDATA[

রাশিয়ার সামরিক অভিযানের ইউক্রেনে যে শরণার্থী সংকট সৃষ্টি হয়েছে তাতে দেশটির জনমিতিগত ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়েছে। সংঘাতে দেশটির জনসংখ্যা যে স্তরে নেমে গেছে সেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব বলেই মনে করা হচ্ছে।

হালাইনা তারাসেভিচ আর কখনও ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে ফিরে যাবেন না। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি সংঘাত শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরই পরিবার নিয়ে দেশ ছাড়েন ৩৮ বছর বয়সী এ নারী।

সীমান্ত পার হয়ে প্রতিবেশী দেশ মলদোভায় ঢোকেন তারা। আশ্রয় নেন সেখানকার এক জনাকীর্ণ শরণার্থী শিবিরে। প্রায় তিন মাস পর সেখান থেকে সুইজারল্যান্ডে পাড়ি জমান। দেশটির সরকার তাদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের অনুমোদন দিয়েছে।

হালাইনার তারাসেভিচের দুই সন্তান। ১২ বছর বয়সী ওলেনা ও সাত বছরের মিকোলা। সম্প্রতি তারা সেখানকার স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। জার্মান ভাষার ওই স্কুলে শিক্ষক ও সহপাঠীরা তাদের নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে।

সম্প্রতি আল জাজিরাকে এক সাক্ষাৎকারে নিজের নতুন জীবনের নানা দিক দিয়ে কথা বলেছেন হালাইনা তারাসেভিচ। নতুন জায়গা ও নতুন জীবন নিয়ে তিনি বলেন, তারা (সন্তানরা) এ জায়াগাটা বেশ পছন্দ করছে। আমরা এখানকার মানুষের অনেক দয়া ও সহানুভূতি পেয়েছি।

হালাইনা লেখাপড়া জানা এক স্বাবলম্বী নারী ছিলেন। ইতিহাসের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি রয়েছে তার। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে তাদের একটি স্টেশনারির দোকান ছিল। স্বামী ওলেহর সঙ্গে মিলে দোকানটা চালাতেন তিনি। এতে চারজনের সংসার নিয়ে একরকম চলছিল তাদের।

আরও পড়ুন: এরদোগান একজন প্রভাবশালী বিশ্বনেতা: পুতিন

এর মধ্যেই যুদ্ধ শুরু হয়। ফলে সন্তানদের কথা চিন্তা করে দেশ ছাড়েন হালাইনা। তবে তার স্বামী ওলেহ এখনও ইউক্রেনেই রয়েছেন। কারণ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই ইউক্রেন সরকার ১৮ থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত পুরুষদের দেশ ছাড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই থেকে যেতে হয় তাকে। আর তাই একা একাই দোকান চালাচ্ছেন তিনি।

ওলেহও সুইজারল্যান্ডে তার পরিবারের সঙ্গে যোগ দিতে চান। সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেই ইউক্রেন ছাড়বেন তিনি। যুদ্ধের কারণে লাখ লাখ ইউক্রেনীয় নাগরিক ঘরবাড়ি ও ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছেন। তাদের মতোই কিয়েভের তিন কক্ষের ফ্ল্যাটটা হারিয়েছেন হালাইনাও। তবে হালাইনার জন্য সুখের বিষয় এই যে, তার পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনদের কেউ এখনও এই সংঘাতে নিহত হননি।

হালাইনা আর ইউক্রেনে ফিরে যাবেন না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে সুইজারল্যান্ডেই স্থায়ী হবেন। তার স্বামী ওলেহরও সেটাই চাওয়া। আল জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনে কোনো ভবিষ্যৎ নেই।’ কারণ হিসেবে সরকার ও প্রশাসনের ব্যাপক দুর্নীতি ও যুদ্ধের ফলে অর্থনৈতিক মন্দার কথা বলেছেন তিনি।

ওলেহ জানান, যুদ্ধের আগেও তার ব্যবসা খুব একটা ভালো চলছিল না। যুদ্ধ শুরুর হওয়ার পর ব্যবসার পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এখন অন্য কোনো ব্যবসা শুরু করাও ঝুঁকিপূর্ণ বলেও জানান ওলেহ। ফলে ব্যবসা ছেড়ে চাকরির কথা ভাবছেন তিনি।

আরও পড়ুন: কিয়েভ অঞ্চলকে নজিরবিহীন বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন রাখার পরিকল্পনা

ওলেহ জানান, স্কুলে এক সময় জার্মান ভাষা পড়েছেন। ভাষাটা মোটামুটি জানা আছে তার। আর সুইজারল্যান্ডে গিয়ে সেটাই কাজে লাগানোর পরিকল্পনা তার। এটা দিয়ে সেখানেই কম বেতনের একটা চাকরি জুটে যাবে বলেই তার বিশ্বাস।

সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করাই এখন একমাত্র লক্ষ্য ওলেহ’র। আর তাই সোভিয়েত আমলের একটা জনপ্রিয় স্লোগান আওড়ান তিনি। যার অর্থ করলে অনেকটা দাঁড়ায় ‘আমরা সন্তানরা যেন থাকে দুধে-ভাতে।’

হালাইনার পরিবার আর ইউক্রেনে ফিরবে না-এর অর্থ হচ্ছে ইউক্রেনের জনসংখ্যা থেকে চারজন কমে যাবে। যুদ্ধের কারণে হালাইনার পরিবারের মতো লাখ লাখ পরিবার ইউক্রেন ছেড়েছে।

এর ফলে জনমিতির দিক দিয়ে ইউক্রেনে একটা বড় সংকট সৃষ্টি হবে। যার শুরু আসলে চলমান যুদ্ধের কয়েক দশক আগেই। ১৯৯১ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীন হয় ইউক্রেন। সেই সময় দেশটির জনসংখ্যা ছিল ৫ কোটি ২০ লাখ।

স্বাধীনতা পরবর্তী বছরগুলোতে সেই জনসংখ্যা বাড়ার বদলে ক্রমেই কমেছে। সবশেষ সরকারি হিসাব মতে অর্থাৎ খাতা-কলমে দেশটির জনসংখ্যা ৪ কোটি ৩০ লাখ। ইউক্রেনে সবশেষ আদমশুমারি হয়েছিল ২০০১ সালে। অর্থাৎ এখন থেকে ২১ বছর আগে। ওই আদমশুমারিতে রাশিয়া অধিকৃত ক্রিমিয়ার ২০ লাখ ও ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের প্রায় ৭৩ লাখ জনসংখ্যা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

আরও পড়ুন: আসন্ন দশক হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের চেয়েও বিপজ্জনক: পুতিন

২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে রাশিয়া। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক ওই বছরই স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এরপর গত মাসে দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের সঙ্গে নতুন করে ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় খেরসন ও জাপোরিঝিয়া- মোট চারটি অঞ্চল রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত হয়। ২০০১ সালের আদমশুমারির তথ্য মতে, সেই সময় খেরসনের জনসংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৭৫ হাজার আর জাপোরিঝিয়ায় ছিল ১৯ লাখ ২৯ হাজার।

এদিকে সংঘাতের ফলে ইউক্রেনে যে শরণার্থী সংকট শুরু হয় তাতে জনসংখ্যার বিশাল একটা অংশই দেশ ছেড়েছে। জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থার তথ্য মতে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গত ৯ মাসে প্রায় ৭৭ লাখ ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। যাদের ৯০ ভাগই নারী ও শিশু। এছাড়া আভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হয়েছে আরও প্রায় ৮০ লাখ মানুষ।

ইউরোপে যেতে ইউক্রেনীয়দের ভিসা লাগে না। এ সুযোগ কাজে লাগে যুদ্ধের আগে থেকেই দেশটির অন্তত ৮০ লাখ মানুষ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছিল। ওই সব দেশে তাদের অনেকেই পার্টটাইম বা ফুলটাইম চাকরি করছে।

আবার ইউক্রেনীয়দের জন্য ইউরোপে ওয়ার্ক পারমিট পাওয়াও অন্যান্য দেশের চেয়ে সহজ। ফলে ইউক্রেনের অনেকেই সেখানে মৌসুমি কৃষিশ্রমিক, চালক নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে করতে করেন। তারা কেবল ইস্টার বা ক্রিসমাসের ছুটিতে বাড়ি বেড়াতে আসেন।

মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে এসব ইউক্রেনীয় এককালীন যে অর্থ আনেন তা দিয়ে গ্রামে কিংবা উপশহরে নতুন একটা বাড়ি বা একটা ফ্ল্যাট অনায়াসেই কিনতে পারেন তারা। এছাড়া সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ পোল্যান্ডের লাখ লাখ তরুণ ইউরোপের অন্যান্য দেশে পাড়ি জমানোয় দেশটিতে ইউক্রেনীয়দের জন্য চাকরির বড় বাজার তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন: আরও অস্ত্র তৈরির নির্দেশ পুতিনের

ফলে বহু ইউক্রেনীয়রা বিশেষ কিছু দেশটির তরুণরা দেশের চেয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে চাকরির পাশাপাশি স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে।

যেমনটা নিজের ১৯ বছর বয়সী ছেলে আলেকসান্দারের ব্যাপারে বলছিলেন কিয়েভের বাসিন্দা কাতেরিনা মেখাইলেঙ্কো। তিনি বলেন, ‘সে (আলেকসান্দার) মাত্র ১৬ বছর বয়সে জার্মানি সফর করে। ফিরে এসেই সে আমাকে জানায়, সে জার্মান ভাষা শিখছে। সে জার্মানির একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়।’

বর্তমানে আলেকসান্দার জার্মানির শীর্ষ এক বিশ্ববিদ্যালয় হামবুর্গ ইউনিভার্সিটিতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন। পাশাপাশি একটা পার্টটাইম চাকরিও করছেন তিনি। সেখানে মন্টিনিগ্রোর এক মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তার। পড়াশোনা শেষ করার পর সেখানেই স্থায়ী হওয়ার পরিকল্পনা তার।

ইউক্রেন সবমিলিয়ে ইউক্রেনের জনসংখ্যা ইতোমধ্যে অনেকটাই কমে গেছে। তাছাড়া দেশটির জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, দেশটিতে ২০২০ সালে প্রতি হাজার নারীর সন্তান জন্ম দেয়ার হার ছিল মাত্র ১.২২ যা বিশ্বে সর্বনিম্ন। যেখানে কানাডায় ১.৪, রাশিয়ায় ১.৫১, যুক্তরাজ্যে ১.৫৬ ও পেরুতে ২.২২।

ইউক্রেনের নিম্ন জন্মহার দেশটিতে প্রাকৃতিকভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টিকে অসম্ভব করে তুলেছে। ফলে প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে। যা যুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে যারা দেশ ছেড়েছে তাদের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনাও কমে আসবে।

এ নিয়ে ইতোমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশটির বিশ্লেষকরাও। কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক আরেকসি কুশ যেমনটা বলছিলেন। তিনি বলেন, ‘ এই মুহূর্তে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন যুদ্ধ পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এটা নির্ভর করবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কৌশলের ওপর।’

এ বিশ্লেষকের মতে, শরণার্থীদের ফেরাতে ইউক্রেনের সরকারের প্রত্যাবাসন কর্মসূচি গ্রহণ করার প্রয়োজন হবে। তবে সেটা একটা বর্ধনশীল অর্থনীতি ছাড়া সম্ভব হবে না। তার মতে, অর্থনীতিতে একটা ভালো প্রবৃদ্ধি তখনই সম্ভব হবে যখন পুরো অর্থনৈতিক মডেল নতুন করে তৈরি করা হবে।

কুশ বলেন, ‘অন্যথা, ইউক্রেন একটা জনমিতিগত সংকটের মধ্যে পড়বে। জনসংখ্যা ৩ কোটিরও নিচে নেমে যাবে। যার মধ্যে ১ কোটিই থাকবে অবসরে ।’

আল জাজিরার প্রতিবেদন থেকে অনুবাদ করেছেন জামির হোসেন  

]]>

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
error: Content is protected !!