ইমরান খান স্থিতিশীল, কোন পথে পাকিস্তান?
<![CDATA[
রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট কোনোভাবেই যেন পিছু ছাড়ছে না পাকিস্তানের। বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে একই ধারা। পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়া ইমরান খানের ওপর আস্থা রেখে সংকট কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার যে স্বপ্ন অনেক পাকিস্তানি দেখছিলেন, তা ভেঙে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু চলমান অস্থিরতার মধ্যেই সম্প্রতি ইমরানের ওপর প্রাণঘাতী হামলার ঘটনায় পাল্টে গেছে অনেক সমীকরণ। বিশ্লেষকরা বলছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ওপর হামলার এ ঘটনা পাকিস্তানকে ঠেলে দিতে পারে খাদের কিনারে। শুধু তাই নয়, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এর প্রভাব পড়তে পারে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতেও।
বড় জয়ের মধ্য দিয়ে ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন ইমরান খান। কিন্তু চলতি বছরের ১০ এপ্রিল জাতীয় পরিষদে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে বিরোধিরা। জাতীয় পরিষদের ভোটে পরাজিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত হন ইমরান। এরপর থেকেই নানা দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করে আসছেন তিনি।
কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সাত মাস পর এসে সম্প্রতি হাজারো নেতাকর্মী নিয়ে আগাম নির্বাচনের দাবিতে লাহোর থেকে ইসলামাবাদ পর্যন্ত দীর্ঘ লংমার্চ শুরু করেন ইমরান খান। আর সেই লংমার্চের এক সমাবেশেই বন্দুক হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তিনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, হামলার এ ঘটনায় একদিকে যেমন ঘুরে যেতে পারে পাকিস্তানের রাজনীতি, তেমনি ইতোমধ্যে সংকটে থাকা দেশটি নিমজ্জিত হতে পারে আরও গভীর সংকটে।
পাকিস্তানের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো শুক্রবার (৪ নভেম্বর) জানিয়েছে, অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছেন ইমরান। তার অবস্থা এখন স্থিতিশীল। এরই মধ্যে হামলার ঘটনা নিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন পিটিআইয়ের এ নেতা। এ সময় তাকে হত্যাচেষ্টার জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং পাকিস্তানের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) একজন শীর্ষ জেনারেলকে দায়ী করেছেন ইমরান।
কিন্তু এসব কিছুর আড়ালেই পাকিস্তানি ভোটারদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে ব্যাপক অবিশ্বাস ও বিরোধ, যা দেশটিকে ঠেলে দিয়েছে আরও বিভক্তির দিকে। সাধারণ নাগরিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যকার কয়েক দশকের ‘অস্বচ্ছ সম্পর্ক’ থেকেই।
আসিফ গনি নামে রাওয়ালপিন্ডির একটি খেলনার দোকানের কর্মী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, কীভাবে আমরা রাজনীতির ওপর বিশ্বাস রাখব, যখন আমাদের নেতারা ধারাবাহিকভাবে প্রমাণ করছেন যে তারা শুধুমাত্র ক্ষমতায় আগ্রহী?
তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকার যখন বিরোধী দলে ছিল, তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করছিল। তখন ইমরান খান বলেছিলেন, তার সরকার মেয়াদ পূর্ণ করবে। এখন ইমরান বলছেন, তিনি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চান। আর সরকার বলছে, তারাও মেয়াদ পূর্ণ করতে চায়। এসব থেকে সাধারণ মানুষ কী সিদ্ধান্ত নেবে?
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুর্তজা সোলাঙ্গির মতে, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে ইমরান খানের তীব্র মন্তব্য এবং সব রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ‘বদমাশের দল’ হিসেবে চিহ্নিত করা পাকিস্তানি সমাজকে মেরুকরণ করেছে। আর ইমরানকে হত্যাচেষ্টা, বিরোধপূর্ণ একটি দেশের সবশেষ লক্ষণ মাত্র।
আরও পড়ুন: হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা আগেই জানতে পেরেছিলাম: ইমরান খান
সোলাঙ্গি বলেন, ধর্মান্ধতা ও অসহিষ্ণুতার বীজ আমাদের রাষ্ট্রের গভীরে বপন করা এবং স্বয়ং ইমরান খানসহ অনেক রাজনীতিবিদ দ্বারা পুষ্ট, যা এখন ফল দিচ্ছে।
গভীর অবিশ্বাস
ক্ষমতা হারানোর পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, মার্কিন সরকার এবং শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের বিরুদ্ধে ত্রিমুখী আক্রমণ শুরু করেন ইমরান খান। এমন প্রচারণা তার দল পিটিআইকে সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে জয়লাভে সহায়তা করেছে ঠিকই, তবে লংমার্চের মধ্য দিয়ে ইসলামাবাদ অবরোধ করে সরকার উৎখাতের পরিকল্পনায় সমর্থন জোগাতে পারেনি। অন্তত হামলার ঘটনার আগ পর্যন্ত ইমরানের লংমার্চে তেমন কোনো জনসমর্থন ছিল না।
রাওয়ালপিন্ডির একটি মেডিকেল কোম্পানির ম্যানেজার আহতাশাম মঙ্গুল বলেন, রাজনীতিবিদরা সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করবে, জনগণ এখন আর তা বিশ্বাস করে না। ইমরান খান দুর্নীতিবাজদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তার আশপাশে থাকা লোকদের দেখলে এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ এসব লোকই কখনও তাদের নির্বাচনী এলাকায় কাউকে উন্নতি করতে দেয়নি। আমরা কীভাবে বিশ্বাস করব যে, তারা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে সফল হতে দেবে?
পাকিস্তানের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধেও ব্যাপক অসন্তোষ রয়েছে, কিন্তু বিকল্প হিসেবে ইমরান খানের প্রতি তেমন উৎসাহ নেই মানুষের। যদিও তার দল, পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সাম্প্রতিক সংসদীয় উপ-নির্বাচনে জয় পেয়েছে, কিন্তু সেখানে ভোট দিয়েছেন মাত্র ৩৫ শতাংশ ভোটার।
দেশটির রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষের অবিশ্বাস এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কেউ কেউ ইমরান খানের ওপর হামলার ঘটনাকে সাজানো নাটক বলেও মনে করছেন। সেলিম নামে এক দিনমজুর বলেন, আমার মনে হয়, ইমরান খান নিজেই হামলার নাটক সাজিয়েছেন। কারণ তার লংমার্চ ব্যর্থ হচ্ছিল এবং তিনি যেকোনো উপায়ে জনসমর্থন পেতে চেয়েছিলেন। সবাই জানে যে, পাকিস্তান চালায় সেনাবাহিনী। তাদের পাশ কাটিয়ে ইমরান খান বড় ভুল করেছেন। জেনারেলরা কখনোই অন্য কাউকে দেশ নিয়ন্ত্রণ করতে দেবে না।
রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ
সামরিক-বেসামরিক দ্বন্দ্ব পাকিস্তানে নতুন কিছু নয়। শুরু থেকে সামরিক শাসনের মধ্য দিয়েই গেছে দেশটি, যা কখনো হয়েছে প্রকাশ্যে; আবার কখনো হয়েছে গোপনে।
সমালোচকরা বলছেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইমরানের বিজয় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ছাড়া সম্ভব হতো না। কিন্তু তিনি যখন ‘মনোনীত’ হওয়ার পরিবর্তে ‘নির্বাচিত’ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, ঠিক তখনই সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আর সেই দ্বন্দ্বের সুযোগ কাজে লাগিয়েই ক্ষমতায় এসেছে বিরোধীরা।
নিউইয়র্কের ইথাকা কলেজের শিক্ষক এবং প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাজা আহমেদ রুমির মতে, দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক নেতারা ঐক্যবদ্ধ না হওয়ার কারণেই পাকিস্তানজুড়ে আজ এই বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।
তিনি বলেন, নেতাদের সবাই মনে করেন যে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ‘চুক্তি’ করে তারা ক্ষমতায় বসবেন। ফলে বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় তারা সেই চুক্তির খোঁজে থাকেন এবং সরকারে গেলে সশস্ত্র বাহিনীর স্বার্থ রক্ষা করে। ধারাবাহিকভাবে এসব চলতে থাকায়, রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা আরও কমেছে।
আরও পড়ুন: আক্রান্ত ইমরান খান এবং কঠিন বাস্তবতায় পাকিস্তানের রাজনীতি
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ইমরান খান প্রায়ই বলতেন, সামরিক সংস্থা তার পক্ষে আছে। কিন্তু ক্ষমতা থেকে অপসারণের জন্য এখন সেনাবাহিনীকেই দায়ী করছেন তিনি।
তবে ইমরান খান তার পূর্বসূরিদের থেকে ভিন্ন বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাজা আহমেদ রুমি। তার যুক্তি, আর যাই হোক, ইমরান অন্তত সাংবিধানিক আধিপত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর ভান করেন না। প্রকৃতপক্ষে ইমরান বেশ স্পষ্ট করেই বলেছেন, সামরিক বাহিনীর উচিৎ তার পক্ষে কাজ করা এবং তাকে ক্ষমতায় ফেরানো।
সমাবেশে প্রাণঘাতী হামলার ঘটনা ইমরান খানকে কীভাবে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিটি সংকটকে একটি সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করার মতো ‘দক্ষতা’ তার আছে। ফলে হামলার ঘটনাকে পুঁজি করে পিটিআইয়ের এই নেতা যে আবারও ক্ষমতায় ফেরার পথ বের করার চেষ্টা করবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এসবের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান কোন পথে যাবে, তা হয়তো সময়ই বলে দেবে।
আঞ্চলিক অস্থিরতা
সংশ্লিষ্টদের মতে, ইমরান খান ফের ক্ষমতায় আসলেও পাকিস্তানের সংকট দূর হয়ে যাবে তা ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং নির্বাচিত না হয়ে, মনোনীত হয়ে ক্ষমতায় ফিরলে দেশটি আরও গভীর সংকটে পড়তে পারে। একইসঙ্গে যা প্রভাব ফেলতে পারে আঞ্চলিক রাজনীতিতেও।
এ অঞ্চলে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান ও চীনের বিরোধ অজানা নয়। সম্প্রতি শাহবাজ সরকারকে সব ধরনের সমর্থন দেয়ার কথা জানিয়েছে বেইজিং, স্বাভাবিকভাবেই যা ক্ষুব্ধ করেছে দিল্লিকে। কিন্তু দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে আপাতত চীনের বিকল্প নেই ইসলামাবাদের সামনে।
অন্যদিকে ক্ষমতা হারানোর পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়েছেন ইমরান খান। ফলে তিনি ক্ষমতায় ফিরলেও পাকিস্তান অর্থনৈতিক টানাপোড়েন কিংবা রাজনৈতিক সংকট থেকে মুক্তি পাবে কি-না, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
]]>