ইলন মাস্কের কাছে নৈতিকতা-মানবতা কি অর্থহীন?
<![CDATA[
স্পেসএক্স, টেসলার মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যার নাম, তাকে চেনেন না বা একবার হলেও তার নাম শোনেননি-এমন মানুষ হয়তো কমই পাওয়া যাবে। আর কেউ নন, বলছি বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্কের কথা। টুইটার কিনে নেয়া এবং পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটির হাজারো কর্মীকে ছাঁটাইয়ের মধ্য দিয়ে সম্প্রতি নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন তিনি। কেউ কেউ বলছেন, এসবই মাস্কের ব্যবসায়িক কৌশল। আবার ইলন মাস্কের নীতি-নৈতিকতা ও মানবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অনেকে বলছেন, স্রেফ শখের বশে টুইটার কিনে এখন খামখেয়ালি আচরণ করছেন তিনি।
ইলন মাস্ক যে এই যুগের বড় উদ্যোক্তাদের একজন, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তবে টুইটার নিয়ে তার সাম্প্রতিক সব কর্মকাণ্ডের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার যেন শেষ নেই। টেসলার সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও ইলন মাস্ক টুইটারের নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার তিন সপ্তাহ পর এসেও সবচেয়ে বেশি টুইট হচ্ছে তাকে নিয়েই।
বিলিয়নেয়ার এই উদ্যোক্তা সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্ট টুইটার থেকে হাজারো কর্মীকে চাকরিচ্যুত করেছেন, বাতিল করা হয়েছে সাপ্তাহিক ছুটি ও হোম অফিস বা ওয়ার্ক ফ্রম হোমের সুবিধাও। এছাড়া অতিরিক্ত কাজ না করলে চাকরি ছাড়তে হবে, মাস্কের এমন ঘোষণার পর টুইটার থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করারও হিড়িক পড়েছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া শুরু করেছেন অনেক বিজ্ঞাপনদাতা, ফলে ব্যাপক লোকসানে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে টুইটার।
পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে ইলন মাস্কের ঘনিষ্ঠরাও বলছেন, ৪৪ বিলিয়ন ডলারে টুইটার কিনে নিয়ে একরকম নিজের হাতেই প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আপাত দৃষ্টিতে তাকে অযোগ্য বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই?
অর্থনৈতিক অনেক বিশ্লেষকের মতে, টুইটার একটি ব্যবসা এবং মাস্ক অত্যন্ত সফল একজন ব্যবসায়ী। ফলে যা করছেন, সে সম্পর্কে তিনি বেশ ভালোভাবেই অবগত। স্বাভাবিকভবেই প্রশ্ন আসে, মাস্কের মূল উদ্দেশ্য তাহলে কী?
‘অতিরিক্ত ওজন’ কমানোর চেষ্টা?
চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে টুইটার রাজস্ব এনেছে ১.১৮ বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে সংস্থাটির মোট খরচ ১.৫২ বিলিয়ন ডলার। পরিচালনা বাবদ এই সময়ের মধ্যে ৩৪৪ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে টুইটার। ফলে ছাঁটাইকাণ্ডের পেছনে প্রতিষ্ঠানের খরচ কমানোই যে ইলন মাস্কের বড় উদ্দেশ্য, তা স্পষ্ট।
বিপরীতভাবে তার এমন পদক্ষেপ অন্য কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে তুলতে পারে বলেও মত অনেকের। সম্প্রতি টুইট বার্তা এক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ইলন মাস্ক টুইটারের ‘তিমিগুলোকে’ খুঁজছেন, যারা প্রকৃতপক্ষে কাজের লোক এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। এ ধরনের কর্মীদের যখন অন্যদের ওজন বহন করতে হয় না, তখন তারা ১০ জনের সমান কাজ করেন।
মাস্কের পক্ষ নিয়ে অলিভার ক্যাম্পবেল নামের ওই টুইটার ব্যবহারকারী আরও লেখেন, আপনার প্রতিষ্ঠানের ৯০ শতাংশ কর্মী যখন ভালো পারফর্ম করতে ব্যর্থ হন, তখন তারা আসলে বাকি ১০ শতাংশ কর্মীর ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেন। টুইটারের ক্ষেত্রে ঠিক তা-ই হয়েছে। আর এ কারণেই ছাঁটাই হয়েছে।
নতুন অর্থ লেনদেন ব্যবস্থা!
৪৪ বিলিয়নে ইলন মাস্কের টুইটার কেনার আগ্রহ দেখে অবাক হয়েছিলেন অনেক পর্যবেক্ষক। তাদের প্রশ্ন ছিল, এটি কি শুধুই মনোযোগ আকর্ষণের জন্য নাকি কোনো প্রতিশোধ? কিন্তু প্রাথমিক ব্যাখ্যায় দাঁড়িয়েছে: পেমেন্ট বা অর্থ লেনদেন ব্যবস্থা। কীভাবে?
১৯৯৯ সালে এক্স ডটকম নামে একটি অনলাইন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন ইলন মাস্ক, যা পরে কনফিনিটির সঙ্গে একীভূত হয়ে অর্থ লেনদেন (পেমেন্ট) ব্যবস্থা পেপ্যাল গঠন করে। কিন্তু পেপ্যাল পেমেন্ট খাতকে কীভাবে ব্যাহত করেছে তা সবারই জানা। মাস্ক কি তাহলে টুইটারকে ব্যবহার করে তার সেই প্রকল্পকে নতুন রূপ দিতে চাচ্ছেন? মরগান স্ট্যানলির সাবেক ব্যাংকার ক্যাটলিন লংয়ের মতে, এর উত্তর ‘হ্যাঁ’।
এছাড়া কয়েকজন বিনিয়োগকারীর বরাতে সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এক্স’ নামটি পুনরুজ্জীবিত করে ২০২৩ সালে টুইটারে একটি ‘রহস্যময়’ নতুন পণ্য চালু করতে যাচ্ছেন ইলন মাস্ক। মাস্কের আশা,২০২৮ সালের মধ্যে তার ‘প্রডাক্ট এক্স’ প্রায় ১১ কোটি গ্রাহক সংগ্রহ করবে।
সফল ব্যবসায়ী
বলা হয়, ইলন মাস্ক যেখানে হাত দেন সেখান থেকেই সফলতা আসে। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে তার ট্র্যাক রেকর্ডও বেশ ঈর্ষণীয়।
টেসলা এবং এক্স ডটকম ছাড়াও ইলন মাস্ক উন্নত রকেট ও মহাকাশযান ডিজাইন, তৈরি এবং তা লঞ্চ করা প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা, সিইও এবং প্রধান প্রকৌশলী।
ফোর্বসের তথ্য অনুসারে, ১৮৮.৩ বিলিয়ন ডলার নিয়ে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ক। তবে টুইটারে তার নতুন কৌশলকে যে সবাই ভালো চোখে দেখছেন না, সেটিও সত্য। অনেক ব্যবহারকারী টুইটারকে বিদায় বলছে এবং এর বিকল্প কোনো সামাজিক মাধ্যম বেছে নিচ্ছেন।
তবে শেষ হাসি মাস্কের হতে পারে। কারণ, চারপাশের আলোচনা টুইটারে আরও বেশি সময় দিতে ব্যবহারকারীদের অনেকটা বাধ্যই করছে। এছাড়া বিষয়টি নিজেও স্বীকার করেছেন ইলন মাস্ক।
‘
আমিই সঠিক’ মনোভাব
সম্প্রতি ধনী আমেরিকানরা অদ্ভুত আচরণ করছেন, বিশেষ করে ইলন মাস্ক কিংবা মার্ক জাকারবার্গের মতো ধনকুবের উদ্যোক্তারা। পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তিরাষ্ট্রের শীর্ষ ০.০০০১৭ শতাংশ ধনী ব্যক্তি এমন আচরণ করছেন। কিন্তু কেন? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব উদ্যোক্তার মাঝে ‘আমি সবসময় সঠিক’- এ ধরনের এক মনোভাব তৈরি হয়েছে, যার পেছনে বহুলাংশে দায়ী সাধারণ মানুষ। কারণ শীর্ষ এই ধনীরা কিছু করলেই, মানুষ সবসময় তাদের বাহবা দেয়। এমনকি ভুল কিছু করলেও, তার মধ্যে ‘অসাধারণ’ কিছু খোঁজার চেষ্টা করেন অনেকে।
ইলন মাস্কের ক্ষেত্রে, তিনি স্পষ্টতই মানুষ তার সম্পর্কে কী ভাবেন, তা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নন। এছাড়া টুইটারে প্রচুর অর্থ লোকসান দেয়ার মতো সামর্থ্যও তার রয়েছে।
মাস্ক নিজেও এক টুইট বার্তায় লিখেছেন যে, অর্থ উপার্জনের জন্য নয়, তিনি সংস্থাটি (টুইটার) কিনেছেন ‘সভ্যতার ভবিষ্যতের’ জন্য।
তবে নিজেদের খামখেয়ালি আচরণ বা মানবতা বিবর্জিত কর্মকাণ্ডে যে ধনকুবেরদের খুব বেশি কিছু যায় আসে না; সেটিও এক চরম সত্য। সম্পদ এবং ক্ষমতাই অনেক বিপদ থেকে তাদের দূরে রাখে, যা বাকিদের জন্য বড় চিন্তার কারণ। তবে ইলন মাস্কের মতো বড় ও আলোচিত উদ্যোক্তাদের সব পদক্ষেপকে ‘জিনিয়াস’ আখ্যা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত না করলেই তাদের খামখেয়ালি আচরণ বন্ধ করা সম্ভব বলে মনে করেন অনেকে।
]]>




