বাংলাদেশ

কিশোরেই সংসারের হাল ধরছে রনিরা, দেখার কেউ নেই

<![CDATA[

রাত দশটার দিকে বাড্ডা লিঙ্ক রোড হয়ে উত্তর বাড্ডার দিকে এগোতেই কানে বাজলো একটি কিশোর কণ্ঠ, ‘ভাই জুতা নেন। জোড়া মাত্র ১৫০ টাকা।’

বাড্ডার গুদারাঘাট থেকে শুরু করে শাহজাদপুর পর্যন্ত প্রতিদিন সন্ধ্যায় ফুটপাতে নানা রকমের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন ব্যবসায়ীরা। সন্ধ্যা থেকে রাত সাড়ে আটটা-নয়টা পর্যন্ত ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাকডাকে সরব থাকে এ এলাকা। কিন্তু নয়টার পরে ধীরে ধীরে নীরব হতে শুরু করে এখানকার ফুটপাতগুলো। শোরগোল মিলিয়ে যায় বাতাসে, নেমে আসে নীরবতা। তখন গাড়ি ছুটে চলার সাই সাই শব্দ ও থেমে থেমে হর্নের আওয়াজ ছাড়া তেমন কিছু আর কানে আসে না।

এমন নীরব হয়ে যাওয়া রাস্তায় ল্যামপোস্টের নিয়ন আলোর নিচে একটি ছেলের কণ্ঠে জুতা বিক্রির এ ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়াতে হলো। তাকিয়ে দেখা গেল, কয়েক ডজন স্যান্ডেলের জোড়া নিয়ে রাস্তার ফুটপাতে বসে আছে একটি কিশোর বয়সী ছেলে ও তার এক সঙ্গী।

কৌতূহলবশত কথা বলে জানা যায়, ছেলেটির নাম মো. রনি। বয়স পনের বছর। সাংবাদিক পরিচয়ে কথা বলতে চাইলে রনির বন্ধু কিছুটা সংকোচবোধ করলেও রনি সাগ্রহে জানায়, ক’দিন ধরে ফুটপাতে জুতা বিক্রি করছে সে। প্রতি জোড়া জুতা ১৫০ টাকা।

আরও পড়ুন: প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন বাস্তবায়নে ইউএনডিপির আহ্বান

সময় সংবাদকে রনি বলে, ‘ভাই, পড়ালেখা বেশি করা হয়ে ওঠে নাই। ছোট থাকতে বাবা আমাদের দুই ভাই ও মাকে রেখে চলে যায়। বড় ভাইয়ের ঠিক-ঠিকানা নাই। ক’দিন বাসায় থাকে, ক’দিন থাকে না। সংসারের দেখাশোনা আমিই করি। আমি চাইলে আমার বড় ভাইয়ের মতো হতে পারতাম। কিন্তু আমার মাকে আমি অনেক ভালোবাসি। তাই সংসারের হাল ধরলাম।’

সারাদিন থাকতে এত রাতে কেন জুতা বিক্রি করছে জানতে চাইলে রনি বলেন, ‘সারাদিন একটা জুতার ফ্যাক্টরিতে কাজ করি। বাড্ডা শাহবুদ্দিন মোড়েই ফ্যাক্টরি। কিন্তু ফ্যাক্টরির মজুরিতে সংসার চলে না। তাই কাজ শেষে ফ্যাক্টরির কাঁচামাল দিয়ে নিজেই জুতা বানিয়ে বিক্রি করি। এতে করে মালিককে লাভের ভাগ দিতে হয়। একজোড়া জুতা বিক্রি করতে পারলে নিজের ১০-২০ টাকা লাভ থাকে।’

ফ্যাক্টরি ও জুতার কাজ করে সংসার চলে কি-না জানতে চাইলে রনি বলেন, ‘প্রতি মাসে ১২-১৩ হাজার টাকা আসে হাতে। চার হাজার টাকা বাসা ভাড়া দেই। বাকি টাকা যায় বাজার-সদাইয়ে। বর্তমান বাজারে জিনিসের যে দাম। কষ্ট হলেও সংসার চলে যায়।’

রাস্তায় বসার জন্য কোনো টাকা-পয়সা দেয়া লাগে কি-না জিজ্ঞেস করতে রনি বলেন, ‘এখানে বসলে লাইনের টাকা দেয়া লাগে। একজন লোক এসে ৭০ টাকা নিয়ে যায়। ফুটপাতে যারা ব্যবসা করে সবারই এভাবে টাকা দেয়া লাগে।’

রনি যেখানে বসে জুতা বিক্রি করছেন সেখান থেকে মিনিট দশেক হাটলেই গুলশান। আলিশান এ এলাকায় যেখানে কিশোর ছেলেরা বেলাশেষে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে প্লে-স্টেশনে মনের আনন্দে গেইম খেলছে কিংবা কাছাকাছি অভিজাত কোনো রেস্টুরেন্টে আড্ডা ও খাওয়া-দাওয়ায় মত্ত, সেখানে একই বয়সের একটি ছেলে চাল-ডালের খরচ ওঠাতে সারাদিনের কাজ শেষে নিজের হাতে বানানো জুতা বিক্রি করে বাড়তি কিছু আয়ের আশায় হেঁকে চলছে, ‘ভাই জুতা নেন, জুতা নেন, ১৫০ টাকা একদাম।’

যেখানে এ বয়সে রনির স্কুলে থাকার কথা সেখানে সংসারের হাল ধরতে বেছে নিতে হচ্ছে কাজ। শুধু একজন রনিই না এ রকম হাজার হাজার রনিরা স্কুল ছেড়ে প্রতিনিয়ত জীবন-জীবিকার জন্য লড়ে যাচ্ছে। যা দেখার কেউ নেই।  

বাংলাদেশে শিশু শ্রম বন্ধে ও একটি শিশুকে সুন্দর একটি শৈশব দিতে সরকার, জাতিসংঘ ও শ’খানেক এনজিওর মতো সংস্থাগুলো বহুদিন ধরে কাজ করে আসছে। তারপরেও রাজধানীসহ দেশের অসংখ্য শিশু সুন্দর শৈশব থেকে বঞ্চিত।

আরও পড়ুন: মাদারীপুরে কিশোর গ্যাং আতঙ্ক

কেন এমন হচ্ছে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সাদেকা হালিম সময় সংবাদকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো এতো এনজিও বিশ্বের আর কোথাও আছে কি-না আমার জানা নেই। কিন্তু একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব আছে। একটি পুঁজিবাদী সমাজে বৈষম্য থাকবেই। এর জন্য পুঁজিবাদকে সমালোচনা করা যায়। কিন্তু শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে হলে সামগ্রিক ও সুষ্ঠু একটি পরিকল্পনা নিয়ে আগাতে হবে।’

সরকারের ভূমিকা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সাদেকা হালিম বলেন, ‘সরকার একা এটার সমাধান দিতে পারবে না। তবে আমি মনে করি, শিশুদের কল্যাণের জন্য আলাদা একটি মন্ত্রণালয় গঠন করা উচিত। নারীদের সঙ্গে শিশু অধিকার মিলিয়ে ফেললে হবে না। এক্ষেত্রে শিশু ও নারীদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় থাকা উচিত।’

]]>

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
error: Content is protected !!