বিনোদন

কৃষকের লোকসান, বাজারে অস্বস্তি, লাভ যায় কার পকেটে?

<![CDATA[

বাংলাদেশের কৃষকের কথা বললেই মানসপটে ভেসে ওঠে হাড্ডিসার এক বিষণ্ন মুখ। এ দেশের কৃষক মানেই দরিদ্র, জীবনযুদ্ধে যে রীতিমতো ক্লান্ত। কৃষক নিজে ফসল ফলিয়ে কম দামে বিক্রি করে আর কেনার বেলায় বাধ্য হয়ে দিতে হয় বেশি দাম।

বাংলা বোর্ড বইয়ের এক সুপরিচিত কবিতার লাইন, ‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা, দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা।’ যে কৃষক দেশের আশা, কেন তার জীবন হতাশায় পরিপূর্ণ? দেশের সেরা এই সাধকদের কেন প্রাপ্য পাওনা দেয়া হচ্ছে না? কেন কৃষক কম দামে পণ্য বিক্রি করলেও সাধারণ মানুষকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে সময় সংবাদের এ প্রতিবেদনে।

প্রায়ই সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে কৃষকের ফলানো ফসল ও সবজি বিক্রি হচ্ছে পানির দামে। যেখানে রাজধানীতে এক কেজি শসা কিনতে হচ্ছে ৬০-৮০ টাকায় এবং টমেটো কিনতে হচ্ছে ১০০-১২০ টাকায়, সেখানে একই সবজি ব্যবসায়ীদের কাছে কৃষক বিক্রি করছেন ১০-১৫ টাকা কেজিদরে।

কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? হাতবদল হলেই কেন পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে দু-তিন গুণ। এ ব্যাপারে জানতে সময় সংবাদের বগুড়া জেলা প্রতিনিধির পাঠানো খবর থেকে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলের সবজি কেনাবেচার অন্যতম বড় কেন্দ্র বগুড়ার মহাস্থান পাইকারি সবজির হাটে পার্শ্ববর্তী গুজিয়া, কীচক, গাড়িদহ, এমনকি নওগাঁ-জয়পুরহাট থেকেও নিজেদের উৎপাদিত সবজি আনেন কৃষকরা। এ বাজারে আসা কৃষকরা জানান, জ্বালানি তেলের দাম, সার, সেচ ও মজুরের খরচ বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে।

বাজারে আসা কৃষক মামুন সময় সংবাদকে বলেন, দেশের খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি নিজের জীবিকার জন্য পড়ালেখা করে কৃষিকাজ করছি। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করতে গেলে ফলন ভালো পাওয়া গেলেও খরচ অনেক বেশি পড়ে যায়। তবে পরিশ্রমের ন্যায্যমূল্য কৃষক পায় না। অথচ পাইকাররা ঠিকই মুনাফা করে।

দালাল, ফড়িয়া, পাইকারসহ অন্যদের সিন্ডিকেটের কথা উল্লেখ করে মামুন বলেন, আমরা এত কষ্ট করে ফসল ফলাই। তারা এসে বাজারে দাম কমিয়ে দেয়। পচনশীল বলে অনেকেই বাধ্য হয়ে লোকসান হলেও বিক্রি করে দেয়। এই সিন্ডিকেট দেখার কেউ নেই।

আরও পড়ুন: সমস্যা থাকলেও সক্ষমতা ও সম্ভাবনা আছে বাংলাদেশের

পাইকার সিন্ডিকেটের পাশাপাশি হাটে প্রতি মণ সবজিতে ৪ কেজি করে ধলতা (বাড়তি) দিতে হয়। এতে ইজারাদার আর পাইকারদের লাভ হলেও প্রকৃত চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন বলে জানান অনেক কৃষক।

কৃষক থেকে ফড়িয়া, ফড়িয়া থেকে পাইকার আর আড়তদার, সেখান থেকে খুচরা ব্যবসায়ী–কয়েক হাতবদলে এসব কৃষিপণ্য ওঠে ক্রেতাদের বাজারের ব্যাগে। যতবার হাত বদলায়, ততবার বাড়ে দাম। পরিবহনের খরচ বৃদ্ধির অজুহাতে দাম বাড়ে আরেক দফা।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, হাটের ইজারাদার থেকে শুরু করে বাজারের কমিটি, প্রত্যেক জায়গায় তাদের কাছ থেকে খাজনা বাবদ নেয়া হয় বাড়তি টাকা। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বাড়তি খাজনার কারণে তারাও খরচের বোঝা চাপান ক্রেতার ঘাড়ে।

এদিকে বাইরের জেলাগুলোতে ট্রাকে করে পণ্য নিতে হলে মহাসড়কে বিভিন্ন জায়গায় তাদের কাছ থেকে পৌরসভা, মোটর মালিক-শ্রমিক সমিতিসহ বিভিন্ন নামে-বেনামে চাঁদা আদায় করা হয়। আগের তুলনায় কমলেও পুলিশের হয়রানিও বন্ধ হয়নি বলে অভিযোগ ট্রাকচালকদের। এতে পরিবহন খরচ বাড়ায় বৃদ্ধি পায় সবজির দাম।

বগুড়ার বাজারের মতো দেশের প্রতিটি পাইকারি বাজারের একই দশা। রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার কারওয়ান বাজারে সময় সংবাদের সঙ্গে কথা হয় ট্রাকচালক ইসহাকের। তিনি বলেন, ভাই, মাল লোডে টাকা, আনলোডে টাকা; রাস্তায় এলাকার নেতাগো চান্দার টাকা আবার পুলিশ ভাইগো ভাগের টাকা। যেই দামেই জিনিস বেচুক না কেন, ঢাকায় আসতে আসতে দাম আকাশছোঁয়া।

দেশের কৃষিব্যবস্থার এমন বেহাল দশা কেন–জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সময় সংবাদকে বলেন, এখানে না কৃষক দাম পায়, না সাধারণ মানুষ কম দামে পণ্য কিনতে পারে। মধ্যস্বত্বভোগী থাকবেই। এটা খারাপ কিছু নয়। কিন্তু খারাপ দিকটি হলো, যখন ব্যবসায়ী ছাড়াও চাঁদাবাজ ও খোদ প্রশাসনের লোকজন এখান থেকে অবৈধভাবে টাকা তোলে। এটা সম্ভব হয় তখনই, যখন ক্ষমতার সঙ্গে এসব অবৈধ কাজ করা মানুষের একটি সম্পর্ক থাকে।

একচেটিয়া কোম্পানিগুলোর আধিপত্যের কথা বলতে গিয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, আমাদের এখানে কিছু একচেটিয়া কোম্পানির সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে যারা কৃষককে কম দামে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করে এবং সেই পণ্য মজুত করে পরে বেশি দামে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করে। বাজারে এসব কোম্পানিই নিজেদের খেয়ালখুশিমতো দাম নিয়ন্ত্রণ করে।

আনু মুহাম্মদ জানান, ফসল ফলাতে কৃষকের যেসব উৎপাদন উপকরণ (সার, সেচ, বীজ, যন্ত্রপাতি) লাগে, তা নিয়ে কৃষক এক রকমের অনিশ্চয়তায় ভোগে। যখন-তখন এসব উপকরণের দাম বেড়ে যায়, এতে খরচও বেড়ে যায়। এ ছাড়া কৃষক জানে না কীভাবে সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। অনেক কৃষকেরই এ সংক্রান্ত কোনো জ্ঞান নেই। এতে ফসল ফলাতে গিয়ে তারা অজ্ঞতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

সুবিধাভোগী মধ্যস্বত্ব সম্প্রদায়ের হাত থেকে কৃষকদের উদ্ধারের ব্যাপারে জানতে চাইলে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রিপন কুমার মণ্ডল সময় সংবাদকে বলেন, কৃষকের হাত থেকে ভোক্তার হাতে পণ্য পৌঁছাতে আমাদের মধ্যস্বত্বভোগী লাগবেই। কিন্তু এটার একটা ব্যবস্থাপনা দরকার। যেখানে যতটুকু দরকার, তার থেকে বেশি হলে সমস্যার সৃষ্টি হয়। কারওয়ান বাজার বা সাদেক খান বাজারের দিকেই তাকান, সেখানে হয়তো বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা কেজিদরে, কিন্তু সেই একই বেগুন ভ্যানে তোলার পর এলাকার দোকানগুলোতে বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজিতে। মাত্র এক হাতবদলে দাম হয়ে যাচ্ছে আকাশ-পাতাল। এটা থামাতে হবে। এটা গেল ভোক্তা স্বার্থ।

এবার কৃষকদের স্বার্থের কথা বললে সেখানেও ব্যবস্থাপনার বিষয়টিই প্রথমে সামনে চলে আসবে। যারা ক্ষুদ্র কৃষক ও খামারি তাদের গ্রুপভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। ধরা যাক, একজন কৃষক মুলার চাষ করেন। এক মৌসুমে তার ক্ষেতে ১ মণ মুলা হলো। এই এক মণ মুলা নিয়ে তো আর ঢাকা আসা যাবে না। কিন্তু এমন ৩০-৪০ জন কৃষক যদি একটি কমিউনিটি তৈরি করে, তাহলে ৩০ মণ মুলা নিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীর সাহায্য না নিয়েই ঢাকা আসতে পারবেন তারা। এতে মূল বাজারেই সরাসরি কৃষক পণ্য বিক্রি করতে পারবেন। এ ছাড়া এই বড় বড় গ্রুপের সঙ্গে চেইন শপগুলো একটি পার্টনারশিপে গেলে কৃষকের পণ্য বিক্রিরও একটি নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে বলে জানান রিপন কুমার মণ্ডল।

কৃষকের লাভ নিয়ে কৃষি উদ্যোক্তা ও খামারিরা জানান, কৃষক কখনোই লাভ করতে পারে না। বিশেষ করে যে দামে কৃষক পণ্য বিক্রি করে, এতে খরচ উঠে আসাকে লাভ ধরা হলেও, মাঠে কৃষকের যে শ্রম তার মজুরি সে কোনোদিনও পায় না। একটি পরিকল্পিত কৃষিব্যবস্থা ও স্বয়ংক্রিয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরই পারে দেশের কৃষি ও কৃষককে স্বাবলম্বী করতে–এমনটাই বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

]]>

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Check Also
Close
Back to top button
error: Content is protected !!