খেয়ে-না খেয়ে কাটছে সন্তানদের জীবন, দিশেহারা বাবা
<![CDATA[
শনিবার দুপুর দুইটা। পানি ঘেরা তিন শতক জায়গার ওপর ভাঙাচোরা ঘরে ঢুকেই চোখে পড়ে এক খাটে চার শিশু। সবচেয়ে ছোট ছেলে শিশু সকাল (৩) পেঁপে দিয়ে থালায় ভাত খাচ্ছে। এদিকে ১১ মাস বয়সী শিশু সুমি দুধের জন্য কান্না করছে। আর তা দেখে ছোট বোন সুমির মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে সকাল।
পাশে বসা আরও দুই শিশু ও দিনমজুর বাবার চোখেমুখে তখন অসহাত্বের ছাপ। একে অপরের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সবাই।
এমন হৃদয়বিদারক অবস্থা বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার রুইয়ার কুল গ্রামে ক্যান্সারে মারা যাওয়া ঝর্না বিশ্বাসের বাড়িতে। মাস দেড়েক আগে চার ভাই-বোনকে রেখে তাদের মা মারা গেলে এমন অবস্থায় পড়তে হয় তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রুইয়ার কুল এলাকার শান্তিরঞ্জন ব্রহ্মার ছেলে সুদাশ ব্রহ্মা ১৩ বছর আগে পার্শ্ববর্তী গ্রামের রাজেশ্বর বিশ্বাসের মেয়ে ঝর্ণা বিশ্বাসকে বিয়ে করেন। দিনমজুর হলেও, স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে শান্তিতে কাটছিল সুদাশ ব্রহ্মার দিন। ১৩ বছরে চার সন্তানের বাবা-মা হন সুদাশ-ঝর্ণা দম্পতি।
বড় সন্তান সজল ব্রহ্মার বয়স ১১; এরপর স্বর্ণালী ব্রহ্মার বয়স ৭, সকাল ব্রহ্মার বয়স ৪ এবং সব থেকে ছোট সুমি ব্রহ্মার বয়স ১১ মাস। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চার সন্তান ও স্বামী সুদাশকে রেখে পরলোকে পাড়ি দেন ঝর্ণা বিশ্বাস। এরপরই ছন্নছাড়া হয়ে যায় সুদাশ ও তার সন্তানদের জীবন। স্ত্রী না থাকায় শিশু বাচ্চাদের ফেলে ঠিকমত কাজেও যেতে পারেন না তিনি। খেয়ে-না খেয়ে দিন যায় তাদের। এ অবস্থায় ছোট চার শিশুকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন দিনমজুর সুদাশ ব্রহ্মা।
আরও পড়ুন: তিন সন্তানের জন্য এক অসহায় বাবার লড়াই
সুদাশের বড় ছেলে ৫ম শ্রেণিতে পড়ুয়া সজল ব্রহ্মা এখন আর স্কুলে যেতে পারেন না। ভাই-বোনদের রান্না করে খাওয়ানো থেকে দেখাশোনা তারই করতে হয় সব। তিনি বলেন, ‘সকালে উঠে ভাই-বোনদের জন্য রান্না করি। এর সাথে তাদের খাওয়ানো, গোসল করানোসহ নানা কাজ করতে করেত দিন যায়। ক্লাস ফাইভে পড়তাম; মা মারা যাওয়ার পর আর স্কুলে যেতে পারি না। আমি স্কুলে গেলে ছোট ভাই-বোনদের কী হবে!’
সজলের বোন প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া স্বর্ণালী ব্রহ্মা বলেন, ‘মা মারা যাওয়ার পরে ছোট বোন সুমি আমার কাছেই থাকে। আমার কাছ থেকে মোটেও যেতে চায় না। থালা-বাটি ধোয়া ও অন্যান্য কাজ করার সময়ও সে আমার পাশে থাকে।’
সুদাশের প্রতিবেশী পুতুল বিশ্বাস বলেন, ‘ঝর্ণা দি অনেক ভাল ছিলেন। হঠাৎ করে মারা যাওয়ায় খুব করুণ অবস্থা তার সন্তানদের। ঘরে খাবার নেই, টাকা-পয়সাও নেই। আমরা কোনোরকম সাহায্যে করি। এছাড়া বাড়ির চারপাশেই পানি, কখন কী ঘটে!’
আরও পড়ুন: অসহায় সুমাইয়ার পরিবারের পাশে বাকেরগঞ্জ ইউএনও সজল
স্থানীয় সুকুমার ব্রহ্মা বলেন, ‘খুবই অসহায় একটা মানুষ সুদাশ। স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে আরও বেশি সংকটে পড়েছে। ধার করে চিকিৎসা করিয়েও বাঁচাতে পারেননি স্ত্রীকে। এখন চার সন্তানকে নিয়ে কীভাবে বাঁচবে জানি না। তবে সরকারিভাবে এ সন্তানদের দেখভালের দায়িত্ব নিলে তারা বেঁচে থাকতে পারবে হয়তো।’
এমন অবস্থায় সরকারের পাশাপাশি বিত্তবানদের সহযোগিতা চান সুদাশ ব্রহ্মা। তাহলে অন্তত ঋণ থেকে মুক্ত হতে পারবেন; পাশাপাশি সন্তানরাও যেতে পারবে স্কুলে। তিনি বলেন, ‘তিন শতক জায়গার ওপর আমার বাড়ি। বাড়ির চারপাশে অন্য লোকের মাছের ঘের। স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে তেমন কাজে যেতে পারি না। কারণ আমি কাজে গেলে বাচ্চাদের দেখবে কে। স্ত্রী মারা যাওয়ার ৪৫ দিনে ১০ দিনও কাজ করতে পারি নাই। তার চিকিৎসা করাতে বেশ ঋণও হয়েছি। এখন খুবই খারাপ অবস্থা। যদি সরকার আমাকে একটু সহযোগিতা করত, তাহলে বাচ্চাদের নিয়ে বেঁচে থাকতে পারতাম।’
এ বিষয়ে চিতলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইয়েদা ফয়জুন্নেছা বলেন, ‘খবর পেয়ে ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিবারটিরকে খাদ্য সহায়তা এবং শিশুদের জন্য দুধ কিনে দেয়া হয়েছে। আমরা তাদের একটি ভিজিডি কার্ড করে দিব। এছাড়া আমি ওই এলাকায় গিয়ে সরকারি সহযোগিতা পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি স্থানীয়দেরও পরিবারটির পাশের দাঁড়ানোর অনুরোধ করেছি।’
]]>




