গল্পটা চড়ুই আর বাদামের
<![CDATA[
১. চীনা নেতা মাও সে তুংয়ের হঠাৎ মনে হলো, যত নষ্টের গোড়া হলো চড়ুই পাখি। সারাদিন ফুরুৎ-ফারুৎ করে উড়ে বেড়ানো আর কৃষকদের ফসল নষ্ট করা ছাড়া এই নচ্ছারগুলোর অন্য কোনো কাজ নেই। তিনি খবর নিয়ে দেখলেন, এই ‘ক্ষুদে শয়তানগুলোর’ এক একটা বছরে সাড়ে চার কেজি করে ধান-গম সাবাড় করে। ১৯৫৮ সালে চড়ুইকে তিনি চীনের উন্নয়নের অন্যতম প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করে সেগুলোকে ধ্বংসের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু ৯৬ লাখ বর্গকিলোমিটারের বিশাল দেশ থেকে চড়ুই নিধন তো চাট্টিখানি কথা নয়! কীভাবে চড়ুই নিধন করা যায়, তা নিয়ে গবেষণা হলো রীতিমতো।
বিজ্ঞানীরা অনেক মাথা খাটিয়ে উপায়ও বের করলেন। শুরু হয়ে গেল ‘দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন’- চড়ুইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। যে সে যুদ্ধ নয়, বলা যায় ‘সর্বাত্মক’ যুদ্ধ। ১৩ ডিসেম্বর সকালে দলে দলে মানুষ ঢাক-ঢোল, থালা-বাসন নিয়ে নেমে পড়ল রাস্তায়। কেউ বাদ গেল না। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া, কারখানার শ্রমিক, সরকারি অফিসের কর্মী, কৃষক, গৃহিনী পিপলস লিবারেশন আর্মির সৈন্য সবাই একসঙ্গে বাজাতে লাগল ঢাক-ঢোল, থালা-বাসন। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, প্রচণ্ড আওয়াজ সহ্য করার ক্ষমতা নেই ক্ষুদ্র চড়ুইয়ের। জোরালো শব্দে হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে মারা যায় তারা। শব্দ করা ছাড়া, চড়ুইয়ের বাসা ভাঙা, ডিম নষ্ট করা, বিষ দিয়ে মারা, গুলি করে মারা-সবই করা হতে লাগল। রাস্তা-ঘাট, খোলা মাঠ, বন-বাদাড়, ঝোপঝাড় ভরে গেল মরা চড়ুইয়ের স্তুপে। ২০ লাখ চড়ুই মারা পড়ল শুধু দুই দিনের ‘ক্যাম্পেইনে’। মোট ৬৫ কোটি চড়ুই সেই ক্যাম্পেইনে হত্যা করা হয়েছিল বলে প্রকৃতিবিদদের অভিমত। এত চড়ুইয়ের মৃত্যুতে স্বস্তি পেলেন মাও। যাক, নচ্ছারগুলোকে শায়েস্তা করা গেছে, আর ফসল নষ্ট করতে পারবে না। পরিবেশবিদ দাই কিংয়ের মতে, পরিবেশ, প্রকৃতি সম্পর্কে মাও সে তুংয়ের কোনো ধারণা ছিল না। তিনি কখনও নিজের পরিকল্পনা নিয়ে আর কারও সঙ্গে আলোচনা করতেন না। তাছাড়া তিনি বিশেষজ্ঞদের মতামতেরও ধার ধারতেন না। তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, চড়ুই ভীষণ ক্ষতিকারক, এগুলোকে মেরে ফেলতে হবে।
চড়ুই ধান-গম খায়, এটা সত্যি কিন্তু সেই সঙ্গে তারা ফসলের জন্য ক্ষতিকর পোকা-মাকড়ও খায় এবং যথেষ্ট পরিমাণেই খায়। চড়ুই নিধনের ফলে এসব পোকা-মাকড় বেড়ে গেল জ্যামিতিক হারে। ক্ষেতের পর ক্ষেত ফসল নষ্ট করল সে সব পোকা-মাকড়ে। ফল হল ভয়ানক। তিন বছর ধরে চলল দুর্ভিক্ষ। মাও সে তুংয়ের সেই চড়ুই নিধনের মূল্য দিতে না খেতে পেয়ে দেড় কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল। ‘গ্রেট ফেমিন’ নামের সেই দুর্ভিক্ষের সময় ক্ষুধার জ্বালায় মানুষে মানুষ খেয়েছে বলেও ইতিহাসে প্রমাণ রয়েছে। শেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে লাখ লাখ চড়ুই আমদানি করে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছিল চীনকে।
আরও পড়ুন: ১০ জানুয়ারি: ‘তিমিরবিদার উদার অভ্যুদয়’
২.
অ্যালমন্ড বা কাঠবাদামের চাহিদা বিশ্বে ব্যাপক। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্য দেখল, তাদের মাটি ও আবহাওয়া এই বাদাম চাষের বিশেষ উপযোগী। যদিও কাঠবাদাম আমেরিকার গাছ নয়, ভূমধ্যসাগর অঞ্চলেই এর আদি নিবাস। তবে বর্তমানে বিশ্বে অ্যামন্ড চাহিদার ৮০ ভাগ মেটায় ক্যালিফোর্নিয়া। অ্যালমন্ড চাষ অত্যন্ত লাভজনক বলে সেখানকার এক অঞ্চলে ৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে করা হলো এর বাগান। বাগান বললে ভুল হবে, কারণ মাইলের পর মাইল, যতদূর চোখ যায় কাঠবাদাম গাছ ছাড়া আর কোনো গাছপালা নজরে পড়ে না। স্বাভাবিক অবস্থায় কী হয়, নানা গাছ থাকে, নানা সময় সেগুলোতে নানা ফুল ফোটে। কিন্তু অ্যামন্ড যেখানে চাষ করা হলো, সেখানে সমস্ত গাছে একসঙ্গে ফুল ফোটে আবার একসঙ্গেই ঝরে যায়। যখন ফুল ফোটে মৌমাছি তা খেয়ে শেষ করতে পারে না। আবার যখন ফুল ফোটা শেষ হয়, তখন শত শত মাইলের ভেতর খাওয়ার মতো এক ফোঁটা মধু পায় না তারা। ফলে মৌমাছিসহ অন্য পোকা-মাকড় হয় মারা গেল না খেয়ে নয়তো চলে গেল অন্য কোথাও। মৌমাছির অভাবে পরাগায়ন না ঘটায় ক্যালিফোর্নিয়ায় অ্যামন্ড উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। পরে অন্যান্য এলাকা থেকে মৌমাছি আমদানি করেই তবে অ্যামন্ড ফলাতে হচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়াকে।
৩.
ঢাকায় লিট ফেস্ট হয়ে গেল দুদিন আগে। সেখানে বক্তব্য রেখেছিলেন ভারতের বিশিষ্ট লেখক ও সাহিত্য সমালোচক অমিতাভ ঘোষ। বাস করেন নিউইয়র্কে। ইংরেজি সাহিত্যে অবদানের জন্যই তাঁর বেশি পরিচিতি। পরিবেশ নিয়েও কাজ করেন। লিট ফেস্টে কথা বলতে গিয়ে জানালেন, প্রকৃতপক্ষে তিনি পূর্ব বাংলারই মানুষ। কারণ, তার বাবা এবং মায়ের বাড়ি এপার বাংলাতেই। তাই এদেশের জল হাওয়া মাটি ও মানুষের জন্য বিশেষ জায়গা রয়েছে তার অন্তরে। অন্তরের সেই আবেগের জায়গা থেকেই তার মুখে শোনা গেল সুন্দরবনের কথা। বললেন, সুন্দরবনই বাঁচিয়ে রেখেছে আমাদের। নইলে ঝড় তুফানের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধ্বংস হয়ে যেতাম আমরা। জানালেন, এই বনের একটা স্বতন্ত্র ও সম্পূর্ণ ইকোসিস্টেম রয়েছে। এমন বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর আর কোনো বনে পাওয়া যায় না। সুন্দরবন যে ঝড়ঝাপ্টা থেকে আমাদের রক্ষা করে, শুধু তাই নয়, ভালো রাখে আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ। আশ্রয় দিচ্ছে অগুণতি পশু-পাখি আর জলজ প্রাণীকে।
আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরা
কিন্তু বন ধ্বংস করাটা যেন আমাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। বৈরী আচরণ করলে প্রকৃতি কিভাবে তার প্রতিশোধ নেয়, এ লেখার শুরুতেই তা উল্লেখ করেছি। শুধু সুন্দরবন নয়, দেশের যে কোন বন, যে কোন পাহাড়, যে কোনো নদী, যে কোনো হাওরে গেলে দেখা যাবে, মানুষ তা অবিরাম নষ্ট করে চলেছে। কখনও বুঝে, কখনও না বুঝে, কখনও উন্নয়নের নামে, কখনও কেবল ক্ষুদ্র স্বার্থ বা ক্ষমতার দাপট দেখাতে। শুধু আইন এর পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না। দরকার সচেতনা। এই ঢাকাতে আমরা যে বাতাসে শ্বাস নিচ্ছি তা পৃথিবীর আর যে কোনো নগরীর চেয়ে দূষিত। রাজধানীর আশপাশে গড়ে ওঠা ইটভাটা, ধুলোবালি আর যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া অবিরাম বিষিয়ে চলেছে নগরীর বাতাস। যাতে শ্বাস নিচ্ছি আপনি আমি, আমারদের সন্তান-সন্ততি আর প্রিয়জনেরা। এর ফল কী, তা নতুন করে বলে দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এই বিষাক্ত পরিবেশ থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে বন। দেশে দেশে শুরু হয়েছে আরবান ফরেস্টিং- নগরীর ভেতরই বন গড়ে তোলা। বিশেষ করে জাপানের মিয়াওয়াকি আরবান ফরেস্টিং অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছে ইতোমধ্যে। বিদেশি গাছপালা নয়, স্থানীয় গাছপালা দিয়েই নগরীর মাঝেই গড়ে তোলা হচ্ছে বন। সে জন্য বাড়তি কোনো জায়গার দরকার নেই। রাস্তার ধারে, জলাশয়ের আশপাশে যে জায়গাটিতে আমরা আবর্জনার ঢিবি বানিয়ে ফেলি, তেমন জায়গাতেই গড়ে তোলা হচ্ছে বন। সাজানো গোছানো পার্কের মত করে নয়, একেবার বনের আদলে। প্রকৃতিবিদরা বলছেন, এতে পরিবেশ ভালো হয়, বাতাসের বিষ দূর হয়। মনোবিদরাও বলছেন, মানুষের মন ভালো থাকে। এখনকার তরুণ সমাজ যে ভয়ানক অবসাদে ভুগছে, নগরীতে বন গড়ে তোলা, সেই দুরূহ সমস্যার সবচেয়ে ভালো সমাধান। প্রকৃতির সঙ্গে বিরোধ নয়। বিজ্ঞানকে, প্রযুক্তিকে, উন্নয়নকে প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে কাজে লাগানোই সব থেকে কল্যাণকর এবং স্থায়ী। তাই সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই বন, পাহাড়, নদী, জলাশয় রক্ষায় আমাদের নতুন ভাবা প্রয়োজন।
]]>