চীনে যেভাবে থামিয়ে দেয়া হচ্ছে বিক্ষোভকারীদের কণ্ঠ
<![CDATA[
চীনের বিভিন্ন শহরে গত কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ চলছে। এ বিক্ষোভ মূলত দেশটির কঠোর করোনাবিরোধী বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে। গত তিন বছর ধরে শত শত বিধিনিষেধ জনগণের ওপর আরোপ করে রেখেছে দেশটির সরকার। শুরু থেকেই বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ হলেও বিক্ষোভকারীদের কণ্ঠ থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ঐতিহ্যবাহী নানা উপায় ব্যবহার করা হচ্ছে।
২০২০ সালের শুরুর দিকে চীনেই প্রথম করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। এরপর গত তিন বছর ধরে একের পর এক লকডাউন ও গণহারে কোভিড পরীক্ষার জেরে দেশের একশ কোটি জনগণের ধৈর্য সহ্যের চরম সীমায় পৌঁছেছে। ধৈর্য ও সহ্যের বাঁধ এখন ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে।
ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত চীনারা এখন প্রশ্ন করতে শুরু করেছে, আর কতদিন তাদেরকে এভাবে জিনপিংয়ের ‘জিরো-কোভিড নীতি’ সহ্য করতে হবে? এই বিক্ষোভ প্রেসিডেন্ট জিনপিং ও সাত দশক ধরে ক্ষমতাসীন চীনা কম্যুনিস্ট পার্টিকে বড় এক রাজনৈতিক পরীক্ষার মুখোমুখি করেছে।
যে অগ্নিকাণ্ডের কারণে বিক্ষোভের সূচনা
গত সপ্তাহে চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ শিংজিয়াংয়ের রাজধানী শহর উরুমকিতে একটি বহুতল ভবনে এক প্রাণঘাতী অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই অগ্নিকাণ্ড ১০ জন পুড়ে অঙ্গার হয়ে মারা গেছে। মূলত ওই অগ্নিকাণ্ডের সূত্র ধরেই দেশজুড়ে কোভিড বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য জনরোষ ছড়িয়ে পড়ে।
চীনে বহু মানুষের মধ্যে যারা বহুতল বহুতল ভবনে থাকে, তাদের আশঙ্কা, আগুন লাগলেও কঠোর লকডাউনের কারণে তারা হয়ত বাইরে বেরুতে পারবে না। যদিও চীনা কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, এ ধরনের আশঙ্কা ‘অমূলক’। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভয়-ক্রোধ তাতে প্রশমিত হচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা সেই ভয় ও ক্রোধ আরও বাড়ছে।
আরও পড়ুন: সংঘর্ষ-ধরপাকড়ের খবর নেই চীনা সংবাদমাধ্যমে
এমন সব ভিডিও ফুটেজ ও অডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়েছে, যাতে বলা হচ্ছে উরুমকির ওই ভবনের লোকজন তাদেরকে বাইরে যেতে দেয়ার অনুমতির জন্য চিৎকার করেছিল। চীনে অনেক মানুষ আশা করেছিল সম্প্রতি অনুষ্ঠিত চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে হয়ত জিরো কোভিড নীতি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হবে। কিন্তু তা হয়নি। বরঞ্চ সেখানে বলা হয়েছে জিরো কোভিড নীতির কোনো বদল হবে না।
ফলে বহুদিন ধরে জমে থাকা ক্রোধ ও ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে চলতি সপ্তাহে। সাংহাই ও রাজধানী বেইজিংয়ের মত বড় বড় শহরে গত কয়েকদিনে হাজার হাজার মানুষ কোভিড বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। এমন বিক্ষোভের নজির দেশটিতে বিরল। সোমবারও (২৮ নভেম্বর) পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে রাস্তায় নামেন কয়েক হাজার মানুষ।
যেভাবে থামিয়ে দেয়া হচ্ছে বিক্ষোভকারীদের
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনে বিভিন্ন বিক্ষোভের ক্ষেত্রে-সে যত ছোট আকারেরই হোক না কেন, সচরাচর সরকারের পক্ষ থেকে যেটা করা হয়, চলমান করোনা বিধিনিষেধবিরোধী বিক্ষোভেও প্রয়োগ করা হচ্ছে। বিক্ষোভ চরম রূপ নিলেও এ নিয়ে কোনো খবর কিংবা কোনো আলোচনা চীনা গণমাধ্যমে নেই। সেই জায়গায় মহাকাশ গবেষণায় চীনের সাম্প্রতিক সব অর্জনের নানা গল্প জোর দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে।
চলমান এ আন্দোলনের নানা খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। পাশাপাশি পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ হচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে নীরব চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম। চলমান বিক্ষোভ নিয়ে সোমবারও কোনো সংবাদ প্রচার করেনি দেশটির প্রভাবশালী চ্যানেল সিসিটিভি।
হাজার হাজার পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন ও ধরপাকড়
বিক্ষোভে উত্তাল চীনের বেইজিং ও সাংহাইসহ বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভস্থলগুলোতে হাজার হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় টহল দিতে দেখা যাচ্ছে পুলিশকে। এর মধ্যে চলছে ধরপাকড়ও।
বিক্ষোভে অংশ নেয়া অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ। বেইজিংয়ের কর্মসূচিতে অংশ নেয়া অন্তত তিন ব্যক্তির বরাত দিয়ে রয়টার্স এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। সূত্র মতে, এক পুলিশ কর্মকর্তা গত রোববার রাতের বিক্ষোভে অংশ নেয়া এক বিক্ষোভকারীকে ফোন করে মঙ্গলবার (২৯ নভেম্বর) তাকে থানায় হাজিরা দিয়ে তার কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে লিখিত দিতে বলেছেন।
আরেক ঘটনায়, এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে তার কলেজ কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ করে যেসব স্থানে বিক্ষোভ হয়েছে সেসব স্থানে সে ছিল কিনা তা জানতে চেয়ে এ বিষয়ে লিখিত জবাব চেয়েছে। নাম-পরিচয় প্রকাশে রাজি না হওয়া এক বিক্ষোভকারী বলেছেন, ‘আমাদের মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছে আমরা মরিয়া হয়ে সেসব ডিলিট করছি।’
আরও পড়ুন: চীনে বিক্ষোভ: বাড়ছে সহিংসতা, নিরাপত্তা জোরদার
ওই বিক্ষোভকারী আরও বলেন, ‘সেখানে এখন অনেক পুলিশ। পুলিশ এসে আমাদের এক বন্ধুর পরিচয়পত্র পরীক্ষার পর তাকে ধরে নিয়ে গেছে। কেন নিয়ে গেছে তা জানিনা আমরা। কয়েক ঘণ্টা পর তাকে ছেড়েও দিয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলেও তাৎক্ষণিকভাবে বেইজিংয়ের জননিরাপত্তা ব্যুরোর পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে রয়টার্স। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের বিভিন্ন শহরে ব্যাপক পুলিশি উপস্থিতির কারণে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে শুরু হওয়া কোভিড বিধিনিষেধবিরোধী বিক্ষোভের ইতি ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
সাংহাইয়ে বিক্ষোভের প্রধান রুট বরাবর রাস্তার দুপাশে নীল রঙয়ের বড় বড় দীর্ঘ ব্যারিকেড বসিয়েছে পুলিশ, বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছে। তারা বিক্ষোভের ছবি তুলতে চেষ্টা করা লোকজনকে বাধা দিচ্ছে। এবং ছবি তোলা হলেও তাদের মোবাইল থেকে সেসব ছবি মুছে ফেলেছে।
রোববার (২৭ নভেম্বর) সাংহাইয়ে এক বিক্ষোভের খবর সংগ্রহকালে বিবিসির এক সাংবাদিককে আটক করা হয়। গ্রেফতারের সময় এড লরেন্স নামের ওই সাংবাদিককে পুলিশ মারধর করে ও লাথি মারে বলে জানা গেছে। অবশ্য আটকের কয়েক ঘণ্টা পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কড়াকড়ি
বিক্ষোভ নিয়ে কথাও বলতে দিতে চায় না চীনা সরকার। আর তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে কঠোর নজরদারি চলছে। বিক্ষোভ নিয়ে কথা বন্ধ করতে চীনা সামাজিক মাধ্যম উইবোতে বহু শব্দ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘সাংহাই’ ও ‘উরুমকি’র মতো শব্দগুলোও রয়েছে। এই দুই শহরে ব্যাপকভাবে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে অধিবাসীরা।
কঠোর কোভিড নীতিমালা বিরোধী বিক্ষোভের জন্য সংগঠিত হতে দেশের বিদেশি অ্যাপ ব্যবহার করছেন চীনা নাগরিকরা। অবৈধ অ্যাপের খোঁজে সাধারণ নাগরিকদের যাত্রাপথে থামিয়ে তাদের ফোন ঘেটে দেখছে চীনের পুলিশ বাহিনী।
আরও পড়ুন: তুষারপাতে বিপর্যস্ত চীন, বিভিন্ন অঞ্চলে সতর্কতা
বিক্ষোভের জন্য সংগঠিত হতে স্থানীয় প্ল্যাটফর্মগুলোর বদলে ইনস্টাগ্রাম, টুইটার ও এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামের মতো বিদেশি অ্যাপগুলো ব্যবহার করছিলেন বিক্ষোভকারীরা। মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, সাংহাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন কেন্দ্রগুলোতে সাধারণ নাগরিকদের ফোনে ওই বিদেশি অ্যাপগুলো আছে কিনা তা খুঁজে দেখছে স্থানীয় পুলিশ বাহিনী। ডয়েচে ভ্যালে জানিয়েছে, একই পরিস্থিতি বেইজিং ও হাংঝৌউয়ের।
প্রযুক্তিবিষয়ক সাইট টেকক্রাঞ্চ ও মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, টুইটার, টেলিগ্রাম ও ইনস্টাগ্রামের মতো নিষিদ্ধ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে ভিপিএন (ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক) ব্যবহার করছেন চীনের বিক্ষোভকারীরা।
চীনের স্থানীয় সামাজিক মাধ্যমগুলোতে কঠোর সেন্সরশিপে আটকে যাচ্ছে বিক্ষোভ প্রসঙ্গ। চীনা সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে বিক্ষোভের নির্ভরযোগ্য খবরগুলো চাপা দেয়ার জন্য ব্যাপকহারে স্প্যাম প্রচারের কথাও শোনা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: ক্ষোভে ফুঁসছে চীন, চ্যালেঞ্জের মুখে শি জিনপিং
সরকারের নিষেধাজ্ঞা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হয়রানি এড়াতে বিক্ষোভকারীরা ‘হোয়াইট পেপার’ ও ‘এ ফোর’র মতো শব্দ ব্যবহার করছে। এই ‘সাদা কাগজ’ এখন বিক্ষোভের প্রতীক হয়ে উঠেছে। কিন্তু এখন এই ‘সাদা কাগজ’ শব্দটিও উইবোতে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে।
বিবিসির প্রতিবেদন মতে, বাক্স্বাধীনতাহীনতার প্রতীক হিসেবে সাদা কাগজ দেখাচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা। এর উদ্দেশ্য হলো, স্পষ্টভাবে কিছু না বলেই নিজেদের কথাটা জানানো। কেউ কেউ এ বিক্ষোভকে ‘সাদা কাগজের বিপ্লব’ বলে মন্তব্য করেছেন।
সিএনএনের দাবি, হাজারো মানুষ রাজপথে নেমে আসার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সমালোচনামূলক পোস্ট, সংবাদ প্রতিবেদন ও স্পষ্টভাষী অনলাইন অ্যাকাউন্টগুলো ইন্টারনেট থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে। বিক্ষোভে ‘সাদা কাগজ’ উঁচিয়ে ধরে তারই প্রতীকী প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে।
]]>