ডিপ স্টেট!
<![CDATA[
ডিপ স্টেটের একটি বিধিবদ্ধ সংজ্ঞা আছে। কিন্তু সেই প্রচলিত সংজ্ঞা অকেজো নয়, আরও বিস্তৃত হয়েছে। রাষ্ট্রের ভিতরে রাষ্ট্র, সরকারের ভিতরে সরকার।
এই ডিপ স্টেট কোনো বিধিবদ্ধ কাঠামো নয়। এরা শক্তিশালী গ্রুপ। যারা রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে সক্রিয় থাকে বিপুল ক্ষমতা নিয়ে। তারা কাজ করে তাদের স্বার্থে, রাষ্ট্র ও সরকারের ক্ষমতা ব্যবহার করে। কিন্তু দায় পড়ে রাষ্ট্র ও সরকারের। তাদের চেনা যায়, দেখা যায়, কিন্তু ধরা যায় না। গেলেও তা খুবই কঠিন।
ডিপ স্টেটের এই আলোচনায় আমার ক্যানভাস বিত্তশালী টাইকুনদের নিয়ে। যাদের আপনারা সবাই চেনেন। আমিও চিনি। রাষ্ট্র চেনে, সরকারও চেনে। কিন্তু আমরা তাদের নিয়ে কথা বলতে সাহস পাই না। রাষ্ট্র ও সরকারও কথা বলে না। কখনো কথা বললেও তা আসলে খুব বেশি কাজে আসে না। কথার জন্য কথা বলা হয়। তবে তাদের শিকার হয় দেশের সাধারণ মানুষ। দেশের সম্পদ। দেশের অর্থনীতি। তারপরও তারা থাকেন। আছেন। হয়তো থাকবেনও। কারণ আগেই বলেছি তারা ডিপ স্টেট। রাষ্ট্রের গভীর ক্ষমতায় তাদের অবস্থান।
দুইটি ঘটনা দিয়ে এবার আপনাদের সামনে এখনকার ডিপ স্টেটকে খোলাসা করছি।
১. একটি মাত্র শিল্প গ্রুপ একটি ব্যাংক থেকেই অনিয়ম করে ৩০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে ঋণের মাধ্যমে। অথচ ওই গ্রুপটির সর্বোচ্চ ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা আছে ২১৫ কোটি টাকা। ওই ব্যাংকটি আবার তাদের নিয়ন্ত্রণে।
২. বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে গত অর্থ বছরে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের আট হাজার ৫৭১টি ঘটনা চিহ্নিত হয়েছে।
এই দুইটি ঘটনার সঙ্গেই জড়িত হলেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা। তাদের বিরুদ্ধে অনেক কথা হলেও দৃশ্যত এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই। সাধারণভাবে পরিস্থিতি বিবেচনায় এদের নিয়ে গরম গরম কথা বলেন তাদের ধরার দায়িত্ব যাদের তারাই। মনে হতে পারে, যেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কিন্তু আসলে তা হয় না। পাবলিক যখন গরম কথায় আশ্বস্ত হয় তখন ধীরে ধীরে ঘটনাগুলো আড়ালে চলে যায়। এটি একটি কৌশল। কারণ ডিপ স্টেট সক্রিয় থাকে ক্ষমতার মধ্যেই। তাই আমাদের এক ধরনের বায়েস্কোপ দেখিয়ে বিনোদন দেয়া হয়, এই যা। তা না হলে চরম আস্থাহীনতা তৈরি হয়। ডিপ স্টেটক টিকিয়ে রেখে সাধারণ মানুষের গুডবুকে থাকার এটা একটা পদ্ধতি।
আরও পদ্ধতি আছে। যেমন বাজেটে পাচারের টাকা একটি নির্ধারিত ফি দিয়ে দেশে আনার সুবিধা দেয়া হয়েছে। এটা অনেক মজার কৌশল। টাকা পাচারও করবে আবার দেশে ফিরিয়ে এনে বাহবাও পাবে। অপরাধী পাবে দায়মুক্তি। আবার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে অপরাধীকে সাদা বানানো হয়। কিন্তু তাদের ধরা হয় না। এবার ডিপ স্টেটের ক্ষমতা বোঝা যাচ্ছে?
কৃষকের কোমরে দড়ি এবং ডিপ স্টেটের দৌরাত্ম্য:
খবরটি আপনারা নিশ্চয়ই জানেন। গত নভেম্বরে পাবনায় ঋণখেলাপি হিসেবে ১২ জন কৃষককে পুলিশ গ্রেফতার করে কোমরে দড়ি বেধে নিয়ে যায়। এই অভিযোগে আদালত মোট ৩৭ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। পুলিশ তাদের ফসলের ক্ষেত থেকে আটক করে। তারা স্থানীয় সমবায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। তবে কৃষকরা দাবি করেছেন ওই ঋণ তারা শোধও করেছেন, কিন্তু তা জমা হয়নি। পরে অবশ্য সমালোচনার মুখে আদালত তাদের জামিন দেন।
আরও পড়ুন: আমরাও পারি
কিন্তু বাংলাদেশে এখন মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ সোয়া লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। গত ডিসেম্বরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। জুন মাসে তার পরিমাণ হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা।
জুন মাসে মোট বিতরণ করা ঋণের ৮.৯৬ শতাংশ খেলাপি। যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ।
তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাই মাসে ঋণ খেলাপিদের জন্য বড় ধরনের ছাড় দেয়। ঋণের শতকরা আড়াই থেকে চার শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয়া হয়। এর আগে এটা ছিল শতকরা ১০ শতাংশ।
ঋণের দায়ে কৃষককে কোমরে দড়ি বেধে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু শীর্ষ খেলাপিদের খেলাপি থেকে নাম কাটাতে সুবিধা দেয় খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের পুলিশ পারবে তাদের কোমরে দড়ি বাঁধতে? পারবে না। কারণ ওই শীর্ষ খেলাপিরা ডিপ স্টেটের অংশ। আর কৃষক হলেন আম জনতা। আম জনতা শাস্তি পায়, ডিপ স্টেট নয়।
ব্যাংকের টাকা লুটপাট ও ডিপ স্টেট:
শুরুতেই তো একটি ব্যাংক থেকে একটি শিল্প গ্রুপের ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে নিয়ে যাওয়ার কথা বললাম। তারা আবার ওই ব্যাংকটিসহ আটটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক। শোনা যায় সিঙ্গাপুরে তারা কয়েকদিন আগে ১৭০ মিলিয়ন ডলারে একটি হোটেল কিনেছে। আরও দুইটি হোটেল আগেই তারা কিনেছেন। তাদের সেখানে শপিংমলও আছে। অন্য দেশেও তাদের সম্পদ আছে। তাহলে বুঝতে পারছেন ওই ঋণের টাকা কোথায় গেছে? এটা কিন্তু ব্যাংকে জমা রাখা সাধারণ মানুষের টাকা। হাইকোর্ট অবশ্য ইসলামী ব্যাংকের যারা এস আলম গ্রুপকে ঋণ দিয়েছে তাদের তালিকা চেয়েছে। ব্যবস্থা এই পর্যন্তই। টাকা কি ফেরত পাওয়া যাবে?
ফেরত না পাওয়ার আশঙ্কা করছি অতীতে উদাহরণের কারণে। বেসিক ব্যাংক থেকে বাচ্চু গংদের নেয়া সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা, সোনালী ব্যাংক থেকে নেয়া হলমার্কের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা, জনতা, প্রাইম, যমুনা, প্রিমিয়ার ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে বিসমিল্লাহ গ্রুপের নেয়া ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংক থেকে অ্যাননটেক্স গ্রুপের নেয়া ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা, একই ব্যাংক থেকে ক্রিসেন্ট গ্রুপের নেয়া দুই হাজার ৭৬০ কোটি টাকা, পিকে হালদারের চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১১ হাজার কোটি টাকা ফেরত আসেনি। ডিপ স্টেট কি টাকা ফেরত দেয়ার জন্য নেয়?
ডিপ স্টেটের টাকা কোথায় যায়, কীভাবে যায়:
বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বলছে, গত অর্থ বছরে (২০২১-২২) বৈদেশিক বাণিজ্যের নামে শতকরা ২০ থেকে ২০০ ভাগ অতিরিক্ত আমদানি মূল্য দেখিয়ে অর্থ পাচারের ঘটনা তারা শনাক্ত করেছে। এটা রফতানি মূল্য কম দেখিয়ে করা হয়। এই ধরনের সন্দেহজন লেনদেনের সংখ্যা গত অর্থ বছরে আট হাজার ৫৭১টি। এই সংখ্যা তার আগের অর্থ বছরের চেয়ে ৬২.৩৩ শতাংশ বেশি। তখন (২০২০-২১) এমন লেনদেন হয়েছে ৫ হাজার ২০৮টি।
আরও পড়ুন: রুবিনা আক্তারের মৃত্যু, আমাদের বিবেক ও শিক্ষা
২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বাণিজ্যের নামে এমন সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে ৩ হাজার ৬৭৫টি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ হাজার ৫৭৩টি। এতে স্পষ্ট যে ব্যাংকিং চ্যানেলে অব্যাহতভাবে অর্থপাচার বাড়ছে। আর গত অর্থ বছরের অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে ব্যাংকিং চ্যানলে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ উল্লেখ না করলেও ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকা।
কম রফতানি মূল্য (আন্ডার ইনভয়েসিং) এবং বেশি আমদানি মূল্য (ওভার ইনভয়েসিং) দেখিয়ে বৈদেশি বণিজ্যের নামে অর্থপাচার হলো প্রধান কৌশল। এর বাইরে যত পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলা হয় তার চেয়ে কম পণ্য আমদানি করেও অর্থ পাচার করা হয়।
ধরা যাক, কেউ বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ডলারের পোশাক রফতানির জন্য এলসি খুললেন। কিন্তু বাস্তবে ওই পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার। তাহলে বাংলাদেশে আসবে ১ লাখ ডলার। বাকি ৫০ হাজার ডলার দেশের বাইরে থেকে যাবে। এটা হলো আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থপাচার। আবার কেউ একটি গাড়ি আমদানির জন্য ১ লাখ ৫০ হাজার ডলারের এলসি খুললেন। কিন্তু গাড়ির বাস্তব দাম ১ হাজার ডলার। কিন্তু আমদানি দাম বেশি দেখিয়ে ওই ব্যক্তি ৫০ হাজার ডলার দেশের বাইরে পাচার করে দিলেন।
আবার কেউ ১ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করার জন্য এলসি খুললেন। সেই পণ্যর কন্টেইনার আসলেও বাস্তবে ভিতরে পণ্য নেই। কিন্তু কাস্টমসকে ম্যানেজ করে পণ্য খালাসও দেখিয়ে ফেললেন। এর মাধ্যমে পুরো টাকাটাই তিনি দেশের বাইরে পাচার করে দিলেন। আর এই পাচারের পুরোটাই হয় ব্যাংকিং চ্যানলে।
আর এই পদ্ধতিতে অর্থপাচারের জন্য দেশি এবং আন্তর্জাতিক চক্রগুলো সহায়তা করে। বিনিয়োগের নামে বিদেশে অফসোর কোম্পানি খুলেও অর্থপাচার করা হয়। যে প্রতিষ্ঠানে অর্থ বিনিয়োগের কথা বলা হয় বাস্তবে সেটা হয়তো একটি কাগুজে কোম্পানি।
এর বাইরে আছে হুন্ডির মাধ্যমে পচার। তার পরিমাণও একই রকম হবে। আমাদের রেমিট্যান্স যে কম আসছে তার কারণ এই হুন্ডি। আমরা না বুঝে এ জন্য প্রবাসী কর্মীদের দায়ী করি। কিন্তু যারা দেশ থেকে লোপাট করা টাকা পাচার করে তাদের চক্রই ডলারের বেশি রেট দিয়ে প্রবাসী কর্মীদের হুন্ডিতে উদ্বুদ্ধ করে। বাংলাদেশে প্রবাসীদের পরিবারকে টাকা দেয়। আর প্রবাসে ডলার তারা নিয়ে নেয়। ব্যাস লুটের টাকা চলে গেল ডলার হয়ে দেশের বাইরে। এটা বন্ধ হলে অর্থপাচার বন্ধ হতো। আর প্রবাসীদের পাঠানো ডলার দুইগুণ হতো।
আরও পড়ুন: মহামান্য রাষ্ট্রপতির নির্দেশনায়ও টনক নড়ে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর
বাণিজ্যের নামে ব্যাংকিং চ্যানেলে পাচার ইচ্ছে করলেই বন্ধ করা যায়। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম কত সেটা জানা তো এখন খুবই সহজ। বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সবাই জানে। কিন্তু তারা কি কিছু করে? আর ট্যারিফ কমিশনের কাজই তো হলো আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম প্রতিদিন যাচাই করা।
হুন্ডিও বন্ধ করা যায়। ভারত তো এরকম অনেক ডিপ স্টেটকে দেশে ধরে এনে বিচারের মুখোমুখি করেছে। অর্থ ফেরত এনেছে। তাহলে আমরা কেন পারি না? আমাদের ডিপ স্টেট কি তাহলে ভারতের চেয়েও ডিপ?
শ্যুট ডাউন করবে কে?
বেসিক ব্যাংকের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা পাচার ও লুট সংক্রান্ত একটি মামলার শুনানিতে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ বলছেন, ‘জনগণের টাকা আত্মসাৎ, লুটপাট ও পাচারকারীদের শ্যুট ডাউন করা উচিত। তারা জাতির শত্রু, কেন এসব মামলার ট্রায়াল হবে না?’
কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, তাদের শ্যুট ডাউন করবে কে? এখানে কি ডিপ স্টেটকে শ্যুট ডাউন করা যায়?
]]>




