ঢাকা এখন মেট্রোরেল নগরীর তালিকায়
<![CDATA[
ঢাকা বিশ্বের অন্যান্য দেশের বড় শহরের সাথে তাল মিলিয়ে চলা শুরু করবে বুধবার (২৮ ডিসেম্বর)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল উদ্বোধন করবেন। ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ থেকে জনগণ সীমিত পরিসরে এটি ব্যবহার করতে পারবে। আস্তে আস্তে এতে যাত্রীর সংখ্যা বাড়ানো হবে। পুরো কাজ শেষ হলে উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত যাত্রীরা চলাচল করতে পারবেন। দেরিতে হলেও মহানগরীর যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থায় একটি প্রয়োজনীয় ও বৈজ্ঞানিক উদ্যোগের বাস্তবায়ন হলো। আগামী বছরের মধ্যে এটি উত্তরার সাথে মতিঝিল হয়ে কমলাপুরের সংযোগ স্থাপন করবে। কোথাও একে মেট্রোরেল, কোথাও স্কাইট্রেন আবার কোথাও সাবওয়ে বলে থাকে। জনগণের দ্রুত ও নিরাপদ চলার জন্য এটি চালু করা হয়। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের বড় শহরে এই ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
শহরে লোক বাড়ছে, বাড়ছে গণপরিবহন এবং বাড়ছে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা। ইতোমধ্যে শহরের বেড়েছে ফ্লাইওভারের সংখ্যা। ঢাকার মতো প্রসস্ত রাস্তা বিশ্বের কম শহরেরই রয়েছে কিন্তু তারপরও যানজটের ভোগান্তি থেকে নগরবাসী মুক্ত হতে পারছেন না।
নগরে চলাচল এক অনিশ্চিত পথ চলার মতো। বর্তমান পরিবহন কাঠামোতে যে যানবাহনেই আপনি পথে নামেন না কেন আপনি কখন গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন তা কেউই জানেন না। এতে করে আপনার প্রতিদিনের জীবনে আর স্বস্তি থাকছে না। সড়ক অব্যবস্থাপনা যেমন এর জন্য দায়ী ঠিক একইভাবে অভাব রয়েছে বিকল্প বড় আকারের যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থা। এটিও জানা দরকার, ঢাকা বিশ্বের একমাত্র শহর নয় যেখানেই কেবল এমন যানজট রয়েছে। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য শহর একে নিয়ন্ত্রিত করার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন ব্যাংকক শহরের কথা। এটিকে তিনতলা রাস্তার শহর বলা যেতে পারে। নিচে স্বাভাবিক রাস্তা আছে, দোতলায় রয়েছে সকল ফ্লাইওভার আর বলা চলে তিনলায় রয়েছে এই মেট্রোট্রেন। সেখানে স্বাভাবিক পথে চলাচলকারীরা এক ধরনের যানজটের মধ্যে চলাচল করেন।
যদিও বলতে গেলে পুরো শহরটি একটি ফ্লাইওভারের শহর। কিন্তু নগরের লোকের চলাচলে স্বস্তি দিয়েছে স্কাইট্রেন। একই অবস্থা ভারতের রাজধানী দিল্লিরও কিন্তু সেখানকার যানজট প্রায়ই জনজীবনের অস্বস্তির কারণ হয়ে যায়। কিন্তু সেখানে মেট্রোরেল জনজীবনে চলাচলের স্বস্তি দিয়ছে। যার কারণে ভারতের কলকাতাসহ প্রতিটি বড় শহরের মেট্রোরেলের পরিধি বেড়েই চলছে। সেখানে অবশ্য কোথাও মাটির নিচ দিয়ে আবার কোথাও মাটির উপরে আবার উভয়ের সংমিশ্রণে মেট্রোরেল চলছে।
আরও পড়ুন: মেট্রোরেল উদ্বোধন জনবান্ধব সরকারের আরেকটি সাফল্য: রাষ্ট্রপতি
পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নের মধ্যে সময়ের ব্যবধান থেকেই যায়। ১৯২০ সালে পরিকল্পনা করা ভারতের প্রথম মেট্রোরেল কলকাতা মেট্রোরেল। এটির ১৯৭০ সালে নির্মাণ কাজ শুরু করা হয় আর চালু করা হয় ১৯৮৪ সালে। আজকে এর বিস্তৃতি কলকাতার বাইরে চলে গেছে। ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত, সেখানে প্রতিটি ৩০০ ট্রিপে প্রায় ৭ লাখ যাত্রী যাতায়াত করে। তখনকার সময়ে শহরজুড়ে এমন একটি বড় আকারের অবকাঠামো তৈরি করার জন্য জায়গা পাওয়া যত সহজ ছিল, আজকের বাস্তবতায় তত সহজ নয়। কারণ প্রতিটি বড় নগরীতেই এখন লোক বাড়ছে,বাড়ছে বিল্ডিংসহ নানা অবকাঠামো। তবে অপরিকল্পিত বিস্তৃত ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের অবকাঠামো তৈরিতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। কারণ এখানে বলা চলে বড় ধরনের কোন অবকাঠামো না ভেঙ্গেই প্রথম মেট্রো রেলের অবকাঠামা প্রায় দাঁড়িয়ে গেছে। বাকি পাঁচটি মেট্রোর অবকাঠামো তৈরি করতেও একই ধরনের অভিজ্ঞতাই হওয়ার কথা।
বড় নগরীর গণপরিবহনে কেন মেট্রোরেল দরকার? এর কারণ অনেক। প্রথমটি হচ্ছে, এটি স্বাভাবিক যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত না করে একসাথে অনেক যাত্রী পরিবহন করতে পারে, দ্বিতীয়টি হচ্ছে, এটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে নিজের পথে চলাচল করে কাজেই যান্ত্রিক গোলযোগ ছাড়া এটিতে সময়ের অপচয়ের সুযোগ নেই, তৃতীয়টি হচ্ছে, একসাথে অনেক যাত্রী নির্ধারিত সময়ে চলাচল করার সুযোগ থাকার কারণে প্রথাগত পরিবহন ব্যবস্থার উপর চাপ কমে, এতে করে প্রথাগত পরিবহন ব্যবস্থা এক ধরনের প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে বলে তাদের সেবার মান বাড়ার সুযোগ তৈরি হয় এবং পাশাপাশি জ্বালানি ব্যয় কমে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
আরও পড়ুন: যে কারণে সব স্টেশনে থামবে না মেট্রোরেল
যদিও এটি বড় আকারের দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের একটি উদ্যোগ কিন্তু যাত্রীর সংখ্যা বেশি থাকায় এটি বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে এর যথাযথ ব্যবহার আর রক্ষণাবেক্ষণে নজর রাখাও জরুরি বিষয়। এটি যেহেতু নগরীর গণপরিবহন কাজেই এটি সবাই যাতে ব্যবহার করতে পারে এমন ব্যবস্থায় চালাতে হবে। আমরা এখানে কলকাতার মেট্রো ব্যবস্থাপনাকে উদাহরণ হিসেবে নিতে পারি। প্রতিদিন ভোর ৬:৫৫ মিনিট থেকে রাত ১০:৩০ টা পর্যন্ত এটি চলে। সেখানে যাত্রী প্রতি ভাড়া হচ্ছে সর্বনিন্ম ৫ রুপি আর সর্বোচ্চ ২৫ রুপি। জনগণের সক্ষমতা বিবেচনা করে এটিকে লাভজনক পর্যায়ে চালানোর উদাহরণ তারা তৈরি করেছে। যা ভারতের অন্যান্য বড় শহরগুলো অনুসরণ করছে। ঢাকার এই মেট্রোরেলের প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ৫ টাকা ধরে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে সাপ্তাহিক, মাসিক এবং পারিবারিক কার্ড কেনার সুযোগ থাকবে। তাছাড়াও প্রতিটি স্টেশনে টিকেট কেনার সুযোগ থাকবে। ভাড়ার যৌক্তিকতা নিয়ে কথা বলা চলছে। আশা করছি কর্তৃপক্ষ এসব কথা বিবেচনায় আনবেন। সবার সামর্থ্য বিবেচনায় ভাড়া ধার্য করার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার ও জাপান সরকারের প্রতিষ্ঠান জাইকার যৌথ অর্থায়নে এটি নির্মিত হচ্ছে এবং বাকি মেট্রোরেলগুলো একই ধরনের অর্থায়নে নির্মিত হবে। প্রথম মেট্রোরেলের মোট ব্যয় প্রায় ২ দশমিক ৮২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ধরা হয়েছিল। যার ৭৫ শতাংশ,অর্থাৎ ২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার স্বল্প সুদে দিচ্ছে জাইকা। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলা মেট্রোরেলে পথের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ২০ কিলোমিটারের মতো। পরবর্তীতে এর সাথে কমলাপুর যুক্ত করার কারণে এর দৈর্ঘ্য গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২১ কিলোমিটারের কিছু বেশি। ঘন্টায় এটি ৬০,০০০জন যাত্রী বহন করার হিসেবে দিনে প্রায় ৯ লাখ ৬০ হাজার জন যাত্রী বহন করার কথা রয়েছে।
মেট্রোরেল যে শুধু যাত্রী বহন করে তাই নয়। একে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটে। ব্যাংককের প্রায় প্রতিটি মেট্রোরেল স্টেশনকে বড় বড় শপিংমলের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। এতে করে এর সাথে এক ধরনের পরিকল্পিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে।ঢাকাতেও এ ধরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বহুতলবিশিষ্ট গাড়ি পার্কিং সুবিধাসহ টিওডি হাব এই প্রকল্পেও যুক্ত হলেও নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি পেতো।
মেট্রোরেলের মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে এর যাত্রী। কাজেই একজন যাত্রীর আচরণও অন্যদের জন্য স্বস্তি বা অস্বস্তির কারণ হতে পারে। কারণ এটি জনবহুল শহর। এখানে দিনের কোনো কোনো সময় যাত্রীর সংখ্যা বেশি হতে পারে। তখন এতে চলাচালকারী সবাই যদি আদর্শ আচরণরীতি অনুসরণ না করেন তাহলে অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হতে পারে। নাগরিক জীবনে স্বস্তি দেয়ার জন্য চালু করা যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থা সবাই স্বস্তিদায়ক পরিবেশে ব্যবহার করুক এটিই আমাদের কাম্য, তা না হলে এতো বড় বিনিয়োগও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। কারণ একবার চলার সন্তুষ্টি নিজেকে বারংবার চলা আর অন্যকে এটি ব্যবহার করায় উৎসাহিত করবে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ যতই সক্রিয় থাকুক না কেন আপনি নিজে দায়িত্বশীল হয়ে এটি ব্যবহার করলে আপনি ও সবাই এর সুফল ভোগ করতে পারবেন। আশা করি আমরা সবাই এমনি দায়িত্বশীল হয়ে এই সুযোগকে কাজে লাগাবো এবং টেকসই করে তুলবো।
লেখক-বিজনেস ডেভেলপমেন্ট কন্সালটেন্ট
]]>