বিনোদন

তরুণরাই পারে কওমি শিক্ষা সংস্কার করতে

<![CDATA[

বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো দারুল উলুম দেওবন্দের পাঠ্যধারা অনুসরণ করে। দারুল উলুম দেওবন্দের শুরুর দিকে দরসে নেজামির সিলেবাস সামনে রেখেই সিলেবাস প্রণয়ন করা হয়েছিল। এ জন্য কওমি মাদ্রাসার সিলেবাসকে দরসে নেজামি নাম দেওয়া হয়।

দরসে নেজামি শব্দটি বাগদাদ বা নিশাপুরের মাদ্রাসায়ে নেজামিয়া থেকে আসেনি। অনেকেই মনে করেন বাগদাদের নেজামিয়া মাদ্রাসা থেকে দরসে নেজামির ধারা সূচিত হয়েছে। বিষয়টি মোটেও তা নয়। সেলজুক সাম্রাজ্যের শুরুর দিকে সম্রাট আলপ আরসালান ও মালিকশাহের প্রধানমন্ত্রী নিজামুল মুলক (১০১৮-১০৯২) বাগদাদ, নিশাপুর, ইরান, আফগানিস্তান, খোরাসান ও আরও বহু অঞ্চলে যে মাদ্রাসাগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেগুলোকে মাদ্রাসায়ে নিজামিয়া বলা হতো। হালাকু খান কর্তৃক বাগদাদ পতনের পর সেসব মাদ্রাসা বিলুপ্ত হয়েছে। বর্তমানের দরসে নিজামির সূচনা আরও পরে। লাখনৌ ফিরিঙ্গিমহলের নিজামুদ্দিন সিহালভী (১৬৭৭-১৭৪৮) প্রণীত পাঠপদ্ধতিকেই দরসে নেজামি বলা হয়।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী রহ.-এর সমসাময়িক ছিলেন এই ইতিহাসখ্যাত শিক্ষা সংস্কারক। তিনি ইউরোপ ভ্রমণ করেছিলেন। আরব মিশর ও ইউরোপের পাঠপদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক জেনে ভারতবর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য মুঘল বাদশা আওরঙ্গজেবের সময়ে সপ্তাদশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে দরসে নেজামির এই ধারা প্রবর্তন করেন। তার এই পদ্ধতিতে হাদিসের সর্বোচ্চ গ্রন্থ ছিল মাশারিকুল আনওয়ার ও মিশকাত শরিফ। দর্শন, বিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা, গণিত, ভূগোল, ইতিহাস, সমাজ, জোতির্বিজ্ঞানের উপর প্রায় পঞ্চাশটি বই ছিল তৎপ্রণীত পাঠ্যসূচিতে। বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি, আবু দাউদ, নাসাই, ইবনে মাজাহ বর্তমান সময়ের মাদ্রাসাগুলোর সর্বোচ্চ ক্লাস দাওরায়ে হাদিসের পাঠ্যপুস্তক। এই ছয় কিতাবকে সিহা সিত্তা বলা হয়।

বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, ভারতবর্ষের হাজার বছর মুসলিম শাসনামলে এই বইগুলো পাঠ্য ছিল না। দরসে নেজামীতেও এসব কিতাবের স্থান ছিল না। এখন যেমন এই ছয় কিতাব পড়া ছাড়া কাউকে আলেম মনে করা হয় না তখনকার চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। অবশ্য সিহা সিত্তার চর্চা ব্যক্তিগতভাবে কোনো কোনো আলেম আগেও করেছেন।

আকবর ও জাহাঙ্গীরের সময়ের বিখ্যাত মনীষী শাইখ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী সিহা সিত্তার উপর ভাষ্যও লিখেছেন। কিন্তু এটা পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। মূলত শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী সর্বপ্রথম মক্কা থেকে এই ছয় কিতাবের সনদ নিয়ে আসেন। দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার পর দরসে নেজামির সাথে এগুলো যুক্ত করা হয়। শাহ ওয়ালিউল্লাহ নিজেও তার শৈশব ও তারুণ্যের সময়ে এই ছয় কিতাব পড়েননি। প্রায় এক যুগ দিল্লিতে শিক্ষকতার পর তিনি আরব যান হজ করতে। হজের সফরেই তিনি আবু তাহের কুর্দির কাছে হাদিসের গ্রন্থগুলো পড়েন। দিল্লিতে তার পিতা ও অন্যান্য শিক্ষকদের নিকট তিনি পড়েছেন গণিত ও দর্শনের অসংখ্য বই। প্রাচীন মুসলিম শাসনামলে ইসলামি শিক্ষার কেন্দ্রগুলোতে কুরআন হাদিসের বাইরে এসব শাস্ত্র পড়ানো হতো। ইবনে সিনা ও ফারাবির কিছু কিছু গ্রন্থ স্পষ্টভাবে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক থাকা সত্ত্বেও পাঠদান করা হতো। ইমাম গাযালি তেহাফাতুল ফালাসিফা নামক গ্রন্থে সেসবের খণ্ডন করেছেন। গাযালির খণ্ডনের পরও শত শত বছর সেগুলো মাদ্রাসার পাঠ্য ছিল। কারণ আগের যুগের মাদ্রাসায় মুক্ত পাঠের এক পরিবেশ ছিল।

আরও পড়ুন: দুর্গাপূজা: সম্প্রীতির বাংলাদেশের অপূর্ব প্রকাশ

জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে কোনো সংকীর্ণতা স্থান পেত না সে সময়ে। একজন আরবি সাহিত্যিক ছিলেন মুতানাব্বি (মৃ. ৯৬৫)। তিনি নিজেকে নবী দাবি করেছিলেন। এমন একজন নাস্তিক ও ভণ্ড নবীর কবিতার বই আজও পড়ানো হয় অধিকাংশ মাদ্রাসায়। পুরনো ধারার উদারতার দৃষ্টান্ত এ থেকেই উপলব্ধি করা যেতে পারে। দর্শন ও যুক্তি বিদ্যার যেসব বই দরসে নিজামিতে স্থান পেয়েছিল তার অধিকাংশই ছিল ইসলামি চিন্তা চেতনার বিপরীত। কুরআন হাদিস ফিকাহর বাইরের এই সব শাস্ত্রকে পণ্ডিতরা উলুমে আলিয়া নাম দিতেন। আলিয়া অর্থ মাধ্যম। কুরআন হাদিস যথার্থভাবে বুঝতে হলে দর্শন বিজ্ঞান সমাজ ও ভূগোল ভালো করে বুঝতে হবে। এই যুক্তিতেই তখন এসব শাস্ত্রের পাঠ দেওয়া হতো। কিন্তু এভাবে একেকটা শাস্ত্রের অসংখ্য গ্রন্থ পড়াতে গিয়ে দেখা গেল কুরআন হাদিস থেকে শিক্ষার্থীরা দূরে সরে যাচ্ছে। এ কারণে দেওবন্দের মনীষীরা শাহওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর পাঠ্যক্রমকে প্রাধান্য দিয়ে অন্যান্য শাস্ত্রের কিতাবাদি কমিয়ে কুরআন হাদিস ও ফিকহের বই সংযোজন করেন। শাহওয়ালিউল্লাহ দেহলভী মৃত্যুবরণ করেন ১৭৬২ সালে। এর একশ বছর পর দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই একশ বছর ধরে ভারতবর্ষের বড় বড় জ্ঞানকেন্দ্রগুলোতে হাদিসের কিতাবাদির উপর এতটা জোর দেওয়া হয়নি। খাইরাবাদ, রামপুর, লাখনৌ ফিরিঙ্গিমহল, হায়দারাবাদ, বাদায়ুন কোথাও নয়। কেবল দিল্লির কিছু প্রতিষ্ঠানে সিহাসিত্তা পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। দেওবন্দের মনীষীরা যখন দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেন তখন ভারতে আহলে হাদীসদের খুব উত্থান হচ্ছিল। প্রতিটি মাসআলায় হাদিস দিয়ে দলীল দেওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছিল সাধারণ মানুষের মাঝে। এজন্যই দেওবন্দে হাদিস চর্চার উপর জোর দেওয়া হয় বলে মত ব্যক্ত করেছেন মাওলানা মানাজির আহসান গিলানি। [হিন্দুস্তান মে মুসলমানু কা নিজামে তালিম ও তারবিয়াত ২/১২১]

শুরুতে দেওবন্দেও সিহাসিত্তা পড়ানো হতো না। মূলত মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহি গাঙ্গুহে হাদিসের দরস শুরু করেন। মাওলানা নানুতুবি মিরাঠ ও নানুতায় হাদিসের দরস দিতেন। দেওবন্দে আরও পরে গিয়ে সিহা সিত্তার নিয়মতান্ত্রিক পাঠদান শুরু হয়। দেওবন্দের প্রথম শাইখুল হাদিস হিসেবে ইতিহাসে ইয়াকুব নানুতুবির নাম পাওয়া যায়। যিনি কাসেম নানুতুবির পর দেওবন্দের প্রধান আলেম হন। তিনি এবং তারপর শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দি পূর্ণ সিহা সিত্তার দরস দেন। সেই ধারা এখনও চলমান।

নিজামুদ্দিন সিহালভী যখন ইসাগুজি, উকলিদাস, সুগরা, কুবরা, উসতা, হিদায়াতুল হিকমা, সদরা,শামসে বাযেগা, মাইবুজি, আইনুল কুজাত, কুতবি, সুল্লাম, মুসাল্লাম, আত্তাসরিহ, খুলাসাতুল হিসাব, কালা আকুল, কাজি মুবারক, মুল্লা জালাল, মুল্লা হাসান, শারহুল মাকাসিদ, মাওয়াকিফ, মাতালি, দাওয়ানি, তাওজিহ তালবীহ, শরহে তাহযিব, মির যাহেদ, শরহে জামি, তাহরিরে সাম্ভাট, চুগমীনী, শামসিয়্যা, তাহতানী, আফলাক, জুবদা, পাঞ্জেগঞ্জ, ফুসুলে আকবরি, কাওসাজিয়া, শাফিয়া, সরফে মীর ইত্যাদি পুস্তক পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভুক্ত করেন তখন এসব বই সমসাময়িককালের সাধারণ জ্ঞান হিসেবে চর্চিত হবার উপযোগি ছিল। এসব গ্রন্থ কোনো ধর্মীয় গ্রন্থ নয়। এমন অসংখ্য বই একসময় কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। এসব বইয়ের নাম বর্তমান প্রজন্মের কওমি ছাত্র-শিক্ষক অনেকেই জানেন না। একে একে এসব কিতাব কওমি মাদ্রাসা থেকে উঠে গেছে। কারণ এসব পুস্তক বর্তমান সময়ের উপযোগী নয়। তবে এসব পুস্তকের শূন্যস্থান পূর্ণ করা হয়নি। প্রয়োজন ছিল এসব পরিত্যক্ত কিতাবের স্থানে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের বইসমূহ সংযুক্ত করা।

আরও পড়ুন: ধাক্কা আসছে: সামাল দেয়ার প্রস্তুতি আছে তো?

প্রতিটি বোর্ডের একেকটি গবেষণা সেল থাকবে। যেখানে প্রতিটি বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে গবেষণা করে পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের বোর্ডগুলোতে এমন কোনো গবেষণাসেল তৈরি হয়নি। কওমি মাদ্রাসার সিলেবাস প্রণয়নে অবশ্যই সাধারণ শিক্ষার বিশেষজ্ঞ কিছু সদস্যও থাকা একান্ত আবশ্যক। যাতে করে তারা প্রতিটি ক্লাস অনুসারে ধর্মীয় বিষয়াদির পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার বিষয়াদিও যথাযথভাবে সংযুক্ত করতে পারেন। দারুল উলুম দেওবন্দ গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঘোষণা দিয়েছে, সামনে বছর থেকে সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা শুরুর আগে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করবে। বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোতে দেওবন্দের অনুরূপ ব্যবস্থা নিলেও সুফল দেখা দিবে বলে আশা করা যায়। মাদ্রাসা শিক্ষা ও জেনারেল শিক্ষার মাঝের দূরত্বগুলো ঘুচিয়ে ফেলার সময় এসেছে।

এই কাঙ্ক্ষিত সংস্কার সম্পাদিত হলে স্কুল-কলেজ থেকে মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়া এবং মাদ্রাসা থেকে কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া সহজ হবে। তাতে করে সমাজে তৈরি হবে ভারসাম্য এবং জ্ঞান হবে বাধামুক্ত। তরুণ কাওমিয়ানদের সেদিকেই এগিয়ে যেতে হবে। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তাওফিক দান করুন। আমিন।

]]>

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Check Also
Close
Back to top button
error: Content is protected !!