ধর্ম সম্পর্কে কতটা অজ্ঞ হলে মা সন্তানকে জঙ্গি বানায়
<![CDATA[
একজন মা ছওয়াবের আশায় তার ছেলেকে পাঠিয়েছেন জঙ্গি হতে। ছেলের বয়স মাত্র ১৫। জিহাদের উদ্দেশে ছেলে মায়ের নির্দেশ পালন করতে গেছে তো গেছে আর কোনো খোঁজ-খবর নেই। মায়ের মন তো, হু হু করে কাঁদে। নানা আশঙ্কায় ভোগেন তিনি। মায়ের বোধোদয় হয়। তিনি বুঝতে পেরেছেন এই পথ কোনো শুদ্ধ পথ নয়। এটি কোনো কল্পিত ঘটনা নয়। ইতোমধ্যেই প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এই সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই উদ্বেগও বেড়ে যায়।জঙ্গিবাদের দিকে মানুষের আগ্রহ কেন বাড়ছে?
মূলত আমাদের সমাজের একটা অংশে জিহাদের কথা বলে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার কাজ চলমান রয়েছে। ভালো ভালো পরিবারের সদস্যদেরকে এভাবে জঙ্গি বানানো হচ্ছে। সাধারণত তরুণ ছেলে মেয়েদেরকে এদিকে বেশি আকৃষ্ট করা হয়। এই ছেলেটির বয়স মাত্র পনের, তাকে তারা টার্গেট করে জিহাদি ট্রেনিংয়ের জন্য। কিশোর ও তরুণদেরকে দলে ভেড়ানো তুলনামূলক সহজ। তারা ধর্মের জটিল কিছুই বোঝে না। তাদেরকে যেভাবে বোঝানো হয় সেভাবেই বোঝে। ঘরের পুরনারীদেরও আজকাল দেখা যাচ্ছে সহজেই জিহাদে উদ্বুদ্ধ করা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহাসিক বিভিন্ন ঘটনার সত্য মিথ্যা মিশ্রিত কল্পিত ভিডিও চিত্র তৈরি করে সেগুলো সোশাল মিডিয়ায় ছড়ানো হচ্ছে। সালাহুদ্দিন আইয়ুবি, আর্তুগ্রুল গাজি, রুকনুদ্দিন বাইবার্স, নুরুদ্দিন জঙ্গি, তারেক বিন যিয়াদ, মুহাম্মাদ বিন কাসেম, মুসা বিন নুসাইর, বায়জিদ ইয়ালদারাম, মুহাম্মাদ আল ফাতিহ প্রমুখ মুসলিম বীরের ইতিহাস বিশেষ পদ্ধতিতে উপস্থাপন করা হয়। অনেক প্রকাশক এদের নিয়ে বই করেন। বইয়ের বিজ্ঞাপন হিসেবে ভিডিও তৈরি করেন। সেসব ভিডিও থেকে কপি করে ভিন্ন ম্যাসেজ বের করে জঙ্গিবাদি সংগঠনগুলো। এই সব ভিডিও চিত্রের সাথে উত্তেজক সঙ্গিত পরিবেশন করা হয় এবং বিভিন্নভাবেই জঙ্গিবাদের প্রচারণা চালানো হয়।
উপরের ঘটনায় একটি ভিন্ন দিক আসলো। এই মা তার সন্তানের আরবি শিক্ষার জন্য একজন আরবি শিক্ষক রেখেছিলেন। সেই গৃহশিক্ষকই তাদেরকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে। মাদ্রাসার ছাত্র ও সাধারণ শিক্ষিত তরুণ কিছু ছেলেকে জঙ্গি বানানো হয়েছে। তারপর তাদের মাধ্যমে একেক করে আরও বহু মানুষকেই এই ভুল পথে আনার চেষ্টা চলছে। অদ্ভূত সব নাম দিয়ে সংগঠন খোলা হচ্ছে। যেমন এই মা ও ছেলে যেই সংগঠনে যুক্ত হয়েছেন সেটির নাম হচ্ছে ‘জামাআতুল আনসার ফিল হিন্দ আল শারকিয়া’। এর অর্থ হচ্ছে পূর্ব ভারতে ইসলামের সাহায্যকারী দল। এই নাম থেকে বোঝা যায় এটি কথিত গ্লোবাল জিহাদের অংশ। কেবল বাংলাদেশ এদের টার্গেট নয়। ভারতকে কয়েক ভাগ করে পূর্ব ভাগের সাথে বাংলাদেশকে মিলিয়ে এভাবে একটি সংগঠন দাঁড় করানো হয়েছে। অথবা তারা বাংলাদেশকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বলে প্রচারণা চালাতে এমন নামকরণ করেছে। যাই হোক, এটি আমাদের দেশের জন্য কোনো শুভ সংবাদ নয়।
আরও পড়ুন: মাহফিলের মঞ্চে দ্বন্দ্ব কেন?
ইসলাম চর্চার নানান ধারা গড়ে উঠেছে আমাদের দেশে। এইসব ধারাকে ভুল পথে পরিচালিত করার জন্য জঙ্গিবাদি সংগঠনগুলো ভেতর থেকে নানান কৌশল গ্রহণ করছে। জিহাদের কথা বলেই সাধারণত সরকার ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশের ওপর হামলার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয় জনমানবশূন্য দুর্গম অঞ্চলে। জিহাদের ফজিলত হিসেবে বর্ণিত আয়াত ও হাদিস তারা এসব জঙ্গি কার্যক্রমে ব্যবহার করে। আমাদের ধর্মীয় বক্তারা অনেক সময় না বুঝেই এই জঙ্গিাবাদিদের সাহায্য করেন। জিহাদের কথা বলার সময় অবশ্যই জঙ্গিবাদের কথাও বলা উচিত। জিহাদ ও জঙ্গিবাদ যে এক নয় তা স্পষ্ট করা উচিত। তা না হলে অনেক কিশোরের জীবন এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে। এর আগেও অনেক তরুণকে হিজরতের কথা বলে ঘরছাড়া করা হয়েছে। তরুণ ধার্মিকদের একটা বড় অংশকে দাজ্জালের ভয় দেখিয়ে ঘর থেকে বের করা হচ্ছে। ইমাম মাহদির জন্ম হয়ে গেছে। ইমাম মাহদির দলে যোগ দেয়ার জন্য জিহাদি ট্রেনিং নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে। এমন স্থূল কথা বলেই তাদের ঘর ছাড়া করা হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজে এমন বহু মা আছেন যারা তাদের ছেলেদেরকে ‘দিরিলিস’ ‘আর্তুগ্রুল’ প্রভৃতি টিভি সিরিয়াল দেখিয়ে জঙ্গি মানসিকতায় গড়ে তুলছেন। কেবল ছেলেরাই এর সাথে যুক্ত হচ্ছে তা নয়, কিশোরী মেয়েদেরও উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে জঙ্গি কার্যক্রমে। প্রায় এক দশক আগে সিরিয়ায় একজন বাঙালি কিশোরী আই এসে যোগ দেয়ার ঘটনা পাঠকের মনে আছে। এমন অনেক মেয়ের মনেই স্বপ্ন আছে মুজাহিদদের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার। এটা যে কোনো সুস্থ মানসিকতা নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এসব বাস্তবতা আমরা অস্বীকার করতে পারি না।
আরও পড়ুন: নিখোঁজ কিশোর-তরুণরা গোপন আস্তানায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, ধারণা র্যাবের
রাষ্ট্র বা সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে জিহাদ বলে না। সরকার বিরোধিতার গণতান্ত্রিক পদ্ধতি আছে। জিহাদ আর রাষ্ট্রদ্রোহ আর সরকার বিরোধিতা একটার সাথে আরেকটাকে গুলিয়ে ফেললে ইসলামি পরিভাষা সম্পর্কে দ্বিধা সৃষ্টি হয় ধার্মিক সমাজে। দ্বিনদার মানুষদেরকে এই দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে হবে। আলেম উলামার উচিত জঙ্গিবাদ সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা। জিহাদ আর জঙ্গিবাদ যে এক নয় সেটি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা। বোমাবাজি ও নিরপরাধ মানুষ হত্যা কোনো জিহাদ নয়। কোনো রাষ্ট্রের শৃংখলা নষ্ট করা ইসলামের শিক্ষা নয়। ইসলাম শান্তি ও শৃংখলার ধর্ম। ইসলাম মানবতা ও প্রেমের ধর্ম। ইসলামি হুকুমতের নামে যারা ইসলামী রাজনীতি করেন তাদের উচ্চারণ আরেকটু সংযত হওয়া উচিত। অনেক সময় তারা এমনভাবে কথা বলেন যাতে মনে হয় জঙ্গিবাদিদের কার্যক্রম ইসলামের দৃষ্টিতে ঠিক আছে। অথচ ইসলামের সাথে তাদের দূরতম সম্পর্ক নেই। কুরআন হাদিসের খণ্ডিত অংশ ভুলভাবে উপস্থাপন করেই তারা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে।
ইসলামকে খণ্ডিতভাবে বুঝলে চলবে না। সামগ্রিকভাবেই বুঝতে হবে। ইসলাম প্রকৃতির ধর্ম। মানবপ্রকৃতি বুঝতে হলে যেমন সামগ্রিকতা আবশ্যক, ইসলামকে সামগ্রিকভাবে বুঝতে হবে। একটা মানুষের চোখ কত সুন্দর। কিন্তু কেবল চোখ উপড়ে এনে যদি কাউকে দেখানো হয় তাহলে কতটা ভয়ংকর ব্যাপার হবে। একটা নাক যত সুন্দর হোক, মুখ থেকে নাক আলাদা করে দেখানো হলে তাতে কোনো সৌন্দর্যই থাকে না। একই কথা ইসলামের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ইসলামের মানবিকতা, প্রেম, উদারতা, উন্নত চরিত্র মাধুরিমা, মহৎ ভাবনাসমূহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে অপব্যাখ্যাসম্বলিত জিহাদকে সামনে আনলে সেই ইসলামের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সৃষ্টি করা অসম্ভব হয়ে যাবে। বিশ্বব্যাপী যে ইসলামো ফোবিয়া সৃষ্টি হচ্ছে তার পেছনে মূলত এইসব অপব্যাখ্যা দায়ি। কেবল আলেম উলামা নয় সাধারণ মুসলিমদেরও এবিষয়ে সচেতন হওয়া ও সচেতনতা সৃষ্টি করা একান্ত আবশ্যক।
]]>




