পল্লীনারীর গলায় বিজয়ের মালা
<![CDATA[
বোরকাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরমাল ড্রেস ঘোষণার দাবি জানিয়েছে ইসলামী ছাত্র আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। মানববন্ধন থেকে বোরকাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরমাল ড্রেস ঘোষণা, বায়োমেট্রিকস পদ্ধতিতে শনাক্ত, শিক্ষার্থীকে ভাইভায় উপস্থিত দেখানো এবং কেউ ধর্মীয় পোশাকের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করলে তাকে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানানো হয়। [বোরকাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরমাল ড্রেস ঘোষণার দাবি/ঢাকা পোস্ট/বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক/১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২/]
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই সংবাদ। প্রশ্ন হলো, এই যদি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা হয় তাহলে এর থেকে আর কিছু কি আশা করা যায়? কে, কী পরবে এইটা তার ব্যক্তিগত। এইটা চাপিয়ে দেয়ার কিছু নেই। দাবি আদায় করারও কিছু নেই। তবে কেন এ ধরনের মৌলবাদী আচরণ?
আরব দেশে বোরকা পরা হয় ধুলাবালি থেকে শরীর রক্ষার জন্য। এইটা সেই দেশের আচার। একে জাতীয় পোশাক বানিয়ে যারা রাজনীতি করছে বা করতে চাইছে তারা আসলে কী চাই তা সরলভাবেই বোঝা যায়।
পোশাক নিয়ে যত আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে তার এক শতাংশ যদি রোবটিক্স বা কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে আলোচনা হতো তাহলে বোঝা যেত শিক্ষার্থীরা উন্নতির পথে যাচ্ছে। সব বাদ দিয়ে কথা হচ্ছে পোশাক নিয়ে! এইটা সত্যি বিস্ময়কর।
পোশাকের কথা মনে পড়াতেই মনে পড়লো মাশা আমিনির ঘটনা। মাশা আমিনি ২২ বছরের ইরানের তরুণী। হিজাব পরেনি দেখে ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ তাকে আটক করে ইরানের পুলিশ। এরপর পুলিশ কাস্টডিতে তার মৃত্যু হয়। গণমাধ্যম বলছে, হিজাব না পরায় তাকে পিটিয়ে খুন করেছে পুলিশ। ইরানের পুলিশের বর্বরতা আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের বর্বরতায় পার্থক্য কোথায়। ইরানে পুলিশ হিজাব পরেনি দেখে পিটিয়ে মেরেছে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা জোর করে বোরকাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরমাল ড্রেস হিসেবে চাপিয়ে দিতে চাইছে। দুইপক্ষের চাওয়া-পাওয়া একই।
আরও পড়ুন: ট্রফি উল্লাসে মেতেছে দেশ, রাজসিক সংবর্ধনা সাবিনাদের
১৮ মে ২০২২, বুধবার ভোরে নরসিংদী রেলস্টেশনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণীকে হেনস্তা করা হয়। তরুণী বলেন, বন্ধুদের হেনস্তা করার সময় একজন প্রবীণ নারী ভিক্ষুক ছাড়া আর কেউ প্রতিবাদ করেননি। গালিগালাজ করতে করতে চারজন নারী–পুরুষ মেয়েটির পোশাক ধরে টানছিলেন।
… এক বোরকা পরিহিত নারী ও দুজন পুরুষ ওই নারীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গালিগালাজ করতে থাকেন তাকে। এক ব্যক্তি ভিডিও করছিলেন, তিনি সবচেয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছিলেন।
‘… আমি আসলে কিছু ভুলতে পারছি না। খালি মনে হচ্ছে, আমার সঙ্গে কেন এমন হলো! নিজের ইচ্ছেমতো পোশাকও পরা যাবে না! এক এলাকার লোক অন্য এলাকায় গেলে তো ভালো ব্যবহার করার কথা। আমার সঙ্গে কেন তারা এমন করল? আমার আসলে মানসিক স্থিতিশীলতার জন্য কাউন্সিলিংয়ে যেতে হবে।’ [‘ঘুমের মধ্যেও চিৎকার করে কেঁদে উঠছেন’ নরসিংদীতে পোশাক নিয়ে হেনস্তার শিকার তরুণী / নাজনীন আখতার / প্রথম আলো / ২২ মে ২০২২]
এই একটি ঘটনা অনেককিছু ইঙ্গিত দেয়। আমাদের প্রশাসন, সরকার কি সেই ইঙ্গিত টের পাচ্ছে? শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, ‘যখন বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আমি রোবটিক্স নিয়ে কথা বলব। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কথা বলব। এখন নারীর পোশাকের দৈর্ঘ্য নিয়ে তো কথা বলার সময় না। এখন কপালে টিপ আছে কি নেই, এটা তো প্রশ্ন হতে পারে না।’ [নারীর পোশাক নয়, রোবটিক্স নিয়ে কথা বলার সময় এখন: শিক্ষামন্ত্রী / দ্য ডেইলি স্টার / স্টার অনলাইন রিপোর্ট / ২৯ আগস্ট ২০২২]
প্রশ্ন হলো,বিশ্ববিদ্যালয় যে এইভাবে পিছিয়ে পড়ছে তার উত্তরণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কী করেছে? এক দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমন কোনো গবেষণা বের হয়েছে যা বিশ্ব সমাদৃত? তাহলে কী নিয়ে আমাদের অহংকার? কেন আমরা মিথ্যা সন্তুষ্টিতে ভুগছি?
বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তিনি পদার্থবিজ্ঞানকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন ৫০ বছরে বাংলাদেশের আর কোনো বিজ্ঞানী কি সেই কাজ করতে পেরেছেন? প্রশ্ন হলো, কেন পারেনি? কেন আমাদের গবেষণা বিশ্বে আলোচিত না? কেন আমাদের দেশে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতো আর কোনো বিজ্ঞানী জন্মায় না? এর উত্তর খুঁজতে আশপাশ দেখলেই বোঝা যায়। উত্তর মিলে যাবে।
সাংবাদিক মশিউল আলম যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। সেখানকার অভিজ্ঞতা তিনি তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানান। তিনি লিখেন, ‘আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামে ৩১টা দেশের ৩২ জন লেখকের মধ্যে কেউ বাংলা সাহিত্যের কিছুই পড়েনি; তারা এক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া বাংলার কোনো কবি-লেখককে চেনে না। বাংলা সাহিত্য কিংবা বাংলাদেশ নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।’
শুধু কি সাহিত্যিক বা অনুবাদক, আমাদের দেশে বিশ্বমানের একজন অধ্যাপক কি আছে? যারা গবেষণা করতে চান তারা দেশের বাইরে চলে যান। আমার স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সহপাঠী আছেন যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গবেষণার কাজ করেন কিন্তু তারা দেশে আসবেন না কারণ হলো, এইসব জটিলতা। একে তো কাজের কোনো পরিবেশ নেই, তার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গবেষণা বাদ দিয়ে পোশাক নিয়ে পড়ে আছে। এতে কী আশা করা যায়?
শুধু শিক্ষার্থী কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও বিজ্ঞান বা গবেষণা বাদ দিয়ে ধর্ম নিয়ে পড়ে আছে। টিএসসিতে মেয়েদের নামাজ পড়া নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল কয়েকদিন আগেই। তখন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান গণমাধ্যমে বলেন, ‘নামাজের স্থানের বিষয়ে আমাদের কয়েকজন শিক্ষার্থী এসেছিল। তারা টিএসসিতে নামাজের স্থান চায়। এটা খুব ভালো একটা বিষয়।’
[টিএসসিতে ছাত্রীদের জন্য নামাজের স্থান থাকা ভালো : উপাচার্য / ঢাকা পোস্ট / বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক ঢাবি / ০৫ এপ্রিল ২০২২ /]ড. মো. আখতারুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়েছেন ২০১৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের গবেষণা বা বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার বিষয়ে গণমাধ্যমে কোনো কথা বলতে শুনিনি। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির এই দশা সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বোরকাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরমাল ড্রেস করার বিষয়ে দাবি জানাবে না তো কী করবে?
আমি সত্যিই অবাক হই এই ভেবে, আমরা কোথায় হাঁটছি আর সারা বিশ্ব কোথায় হাঁটছে। ভারতের ২৩টি আইআইটিকে এখন বলা হয়ে থাকে বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানের সিইও তৈরির কারখানা। যেমন আইবিএম-এর সিইও অরবিন্দ কৃষ্ণা, আইআইটি কানপুরের গ্র্যাজুয়েট। গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই আইআইটি খড়গপুরের গ্র্যাজুয়েট। মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেল্লা, অ্যাডোবের সিইও শান্তনু নারায়ণ, নোকিয়ার সিইও রাজীব সুরি, নোভারটিসের সিইও ভাসান্ত নারাশিমহান এরা সবাই আইআইটি গ্র্যাজুয়েট। কেবল আমেরিকার বড় প্রতিষ্ঠানই নয় ভারতের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের অনেক সিইও আছেন যারা আইআইটির শিক্ষার্থী। [সুবর্ণজয়ন্তীতে শিক্ষা ও গবেষণার স্বরূপ দেখা / ড. কামরুল হাসান মামুন / ঢাকা পোস্ট / ০৪ ডিসেম্বর ২০২১]
এত এত হতাশা বা অন্ধকারের ভিড়ে আশা জাগে মনে যখন দেখি, সানজিদা আখতারের মতো নারী ফুটবলার উঠে আসে প্রান্তিক থেকে। তার বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে। তিনি লিখেছেন, ‘যারা আমাদের এই স্বপ্নকে আলিঙ্গন করতে উৎসুক হয়ে আছেন, সেই সব স্বপ্নসারথিদের জন্য এটি আমরা জিততে চাই। নিরঙ্কুশ সমর্থনের প্রতিদান আমরা দিতে চাই। ছাদ খোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনীকে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই। আমাদের এই সাফল্য হয়তো আরও নতুন কিছু সাবিনা, কৃষ্ণা, মারিয়া পেতে সাহায্য করবে। অনুজদের বন্ধুর এ রাস্তাটুকু কিছু হলেও সহজ করে দিয়ে যেতে চাই…
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যেখানে পোশাক নিয়ে মাতামাতি করছে সেখানে কলসিন্দুরের সানজিদাই আমাদের আশা। পরিবেশ মানুষকে টিকে থাকতে বাধ্য করে। ন্যায্যতা শেখায়, অন্যায় শেখায় আবার প্রশ্রয়ও দেয়।
আজ যদি সানজিদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো তবে নিশ্চয় কোন ধরনের পোশাক পরবে বা পরা উচিত, তার দৈর্ঘ্য কতটুকু হওয়া উচিত তাই নিয়ে মেতে থাকতো। পরিবেশই তাকে বাধ্য করেছে সব টিপ্পনী পদদলিত করে উঠে দাঁড়াতে।
যে পরিবেশ শিক্ষার্থীদের বিদ্যা শিক্ষা বাদ দিয়ে পোশাক নিয়ে আন্দোলন করতে বাধ্য করে সেই পরিবেশ আমরা চাই না। যে পরিবেশ গবেষণা বাদ দিয়ে পোশাকের দৈর্ঘ্য কতটুকু হবে তা নিয়ে আলোচনা করতে বাধ্য করে সেই পরিবেশ থেকে আর যাই হোক সানজিদা তৈরি হবে না। আমি বিশ্বাস করি এই অন্ধকার কেটে যাবে। কাটতে বাধ্য। জয় গোস্বামীর মতো আমিও বলতে চাই,
‘অতই সহজ আমাদের মেরে ফেলা?
আমাদের পায়ে রাত্রিচক্র ঘোরে
আমরা এসেছি, মহাভারতের পর
আমরা এসেছি দেশকাল পার করে…’
]]>