প্রতিশ্রুত নতুন ট্যাংকগুলো কি গেম-চেঞ্জার হবে?
<![CDATA[
চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে প্রতিহত করতে পশ্চিমা মিত্রদের কাছে ট্যাংক চেয়ে বারবার আবেদন করে আসছিলেন ইউক্রেনের কর্মকর্তারা। তবে এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়।
অনেক আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত ট্যাংক সরবরাহের ঘোষণা এসেছে। তবে পাঁচটা কিংবা দশটা নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো দেশগুলোর কাছ থেকে মোট ৩২১টি ট্যাংক পাচ্ছে কিয়েভ। প্রশ্ন হচ্ছে, ইউক্রেনের নতুন ট্যাঙ্কগুলো কি তাত্ক্ষণিক গেম-চেঞ্জার হবে? কিয়েভ কি রুশ সেনাদের হঠাতে পারবে? এ ব্যাপারে কি বলছেন বিশ্লেষকরা?
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন অবশ্য বলছে, অনেকেই যেমনটা প্রত্যাশা করছেন যে, ইউক্রেনের নতুন ট্যাংকগুলো ‘গেম চেঞ্জার’ হয়ে উঠবে। চলমান যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। তবে তেমনটা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
সিএনএনের ভাষ্য মতে, যারা আশা করছেন যে, ইউক্রেনে ন্যাটো মিত্রদের দান করা অত্যাধুনিক যুদ্ধ ট্যাঙ্কগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলবে তাদের প্রত্যাশা বাস্তবতার সঙ্গে নতুন করে সামঞ্জস্য করতে হতে পারে। অর্থাৎ যারা ভাবছেন, নতুন ট্যাংকগুলো দিয়ে রাতারাতি ‘কেল্লা ফতে’ হয়ে যাবে, তাদেরকে নতুন করে ভাবতে হবে।
ইউক্রেন সংঘাতের সবশেষ অবস্থা
এ মুহূর্তে উভয় বাহিনীর মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে। ইউক্রেনীয় সেনারা দোনেৎস্কের দক্ষিণ-পশ্চিমে ভুহলেদার শহরের নিয়ন্ত্রণের জন্য রাশিয়ান যোদ্ধাদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ফ্রন্টলাইনের পরিস্থিতি ভয়াবহ। বিশেষ করে পূর্ব দোনেৎস্ক অঞ্চলে রাশিয়া জোর হামলা অব্যাহত রেখেছে।
ট্যাংক পেতে মরিয়া ইউক্রেন
গত বছরের (২০২২ সাল) ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়া। হামলা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ইউক্রেনকে বিভিন্ন অস্ত্রসহ নানান সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো।
রাশিয়ার হামলার শুরু থেকেই পশ্চিমাদের কাছে অত্যাধুনিক ট্যাংক সরবরাহের আবেদন জানিয়ে আসছিল কিয়েভ। চলতি মাসে সেই আবেদন আরও জোরদার করে।
গত ২০ জানুয়ারি এক নিয়মিত ভাষণে দ্রুত ট্যাংক সরবরাহের আহ্বান জানিয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, ইউক্রেনকে ভারী ট্যাঙ্ক দেয়ার ‘কোনো বিকল্প নেই’। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ ব্যাপারে কোনো দ্বিধা করা উচিত নয়।
এরপরই সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারের যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত ওকসানা মারকারোভা বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা প্রতিরোধে আমাদের ট্যাংক দরকার। কালক্ষেপণ করা ঠিক হবে না। তা হলে রাশিয়ার হামলায় আরও বিধ্বস্ত হয়ে যাবে কিয়েভ।
মারকারোভা আরও বলেন, ‘ওই ট্যাংকগুলো রাশিয়ার হামলা থেকে আমাদের প্রতিরক্ষার জন্য খুবই প্রয়োজন।
মারকারোভার দাবি, ‘আসন্ন বসন্তে ইউক্রেনে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা রয়েছে রাশিয়ার। সেই হামলা নস্যাৎ করতেও এই ট্যাংকগুলো আমাদের দরকার।’
কতগুলো ট্যাংক পাচ্ছে ইউক্রেন?
ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের জোর আবেদনের প্রেক্ষিতে কিয়েভকে লেপার্ড ট্যাংক সরবরাহ করতে জার্মানির প্রতি আহ্বান জানায় ফিনল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য প্রভৃতি ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোর নেতারা। তবে এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়।
তবে কয়েক সপ্তাহের প্রচেষ্টায় এই মতপার্থক্য দূর হয়। ইউক্রেনের এ আবেদনে আনুষ্ঠানিকভাবে সাড়া দেয় জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র। দেশ দুটি নিশ্চিত করেছে, কিয়েভ সরকারের প্রতি সমর্থনের অংশ হিসেবে তারা ইউক্রেনে ট্যাংক পাঠাবে।
গত বুধবার (২৫ জানুয়ারি) জার্মান সরকার ঘোষণা দেয়, তারা ইউক্রেনে ১৪টি লেপার্ড-২ ট্যাংক পাঠাবে। সেই সঙ্গে ইউরোপের যে দেশগুলো জার্মান নির্মিত নিজেদের লেপার্ড-২ ট্যাংক ইউক্রেনে পাঠাতে আগ্রহী, তাদেরও অনুমতি দিয়েছে বার্লিন।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ৩১টি এম-১ আব্রামস ট্যাংক সরবরাহের ঘোষণা দেয়। জার্মানির কাছ থেকে এ-সংক্রান্ত ঘোষণা আসার পরই ওয়াশিংটন এ কথা জানায়। আগামী মাসগুলোতে এসব ট্যাংক সরবরাহ করা হবে।
যুক্তরাজ্য নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত ১৪টি চ্যালেঞ্জার্স টু ট্যাংক দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। তারা জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের ট্যাংক দেয়ার ঘোষণাকে স্বাগত জানায়। ফ্রান্স প্রতিশ্রুতি দেয়, তারা এএমএক্স-ফিফটি সিক্স লিক্লার্ক সরঞ্জাম ইউক্রেনে পাঠাবে।
এদিকে বৃহস্পতিবার (২৬ জানুয়ারি) কানাডা সরকার জানায়, তারা ইউক্রেনকে চারটি লেপার্ড-২ ট্যাংক দেবে। সব মিলিয়ে ট্যাংকের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৩২১টি। তবে এগুলো এখনও প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ।
রুশ সংবাদমাধ্যম আরটি জানিয়েছে, জার্মানির রামস্টেইন বিমানঘাঁটিতে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ডিফেন্স কন্টাক্ট গ্রুপের বৈঠকে ১২টি দেশের কর্মকর্তারা কিয়েভে প্রায় ১০০টি ট্যাংক পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
জার্মানির অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রেইনমেটাল ইউক্রেনে ১৩৯ ট্যাংক সরবরাহ করবে। এর মধ্যে ৮৮টি লেপার্ড ওয়ানস ও ৫১টি লেপার্ড টুএফোরস থাকবে। রেইনমেটাল বলছে এ বছর গরমের আগে মাত্র ২৯টি ট্যাংক সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
ট্যাংকগুলো কি তাৎক্ষণিত গেম চেঞ্জার হবে?
ইউক্রেন যে যুক্তরাষ্ট্রের এম-১ আব্রামস, জার্মানির লেপার্ড ও ব্রিটিশ চ্যালেঞ্জার ট্যাংক পাবে তা অনেকটাই নিশ্চিত। তবে কিয়েভের সামনে আসল চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। আর সেটা হচ্ছে, কার্যকরী যুদ্ধ ইউনিটের মাধ্যমে একেবারেই ভিন্ন ও জটিল ধরনের অস্ত্র পরিচালনার বিষয়টি।
এছাড়া ইউক্রেনীয়দের অবশ্যই ট্যাংকগুলো সরবরাহের সময়সীমার বিষয়টি মনে রাখতে হবে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, যে ট্যাংকগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে একটি বড় পার্থক্য আনবে বলে আশা করা হচ্ছে তা হাতে আসতেই কয়েক মাস সময় লেগে যাবে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের আব্রামস ট্যাঙ্কগুলোর মোতায়েন ও কার্যকর হতে এক বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে।
পেন্টাগনের অন্যতম মুখপাত্র সাবরিনা সিং বৃহস্পতিবারই (২৬ জানুয়ারি) বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে যে এম১এ২ সরবরাহ করবে তা এই মুহূর্তে আমাদের স্টকে নেই। তিনি আরও বলেন, ইউক্রেনে সেগুলো স্থানান্তর করতে ‘কয়েক মাস সময় লাগবে’।
এদিকে আরটির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, অদক্ষ ক্রু এসব ট্যাংক পরিচালনা করার কারণে ফলাফল নেতিবাচক হতে পারে। তাই মার্কিন ট্যাংকগুলো পরিচালনার জন্য ক্রুদের অবশ্যই প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ট্যাংক মেরামতকারী ইউনিট, স্থানান্তরকারী দলকে ট্যাংক পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে হবে।
কৌশলগত স্তরে সাফল্য পেতে হলে ইউক্রেনের বাহিনীতে অন্তত ২০০ থেকে ৩০০ মার্কিন ট্যাংক থাকা প্রয়োজন। এছাড়া এমওয়ান আব্রামস ট্যাংক ইউক্রেনে সরবরাহ করলে সামরিক অথবা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোনো সাফল্য আসা সম্ভব নয়। এছাড়া এ পর্যন্ত শক্র সরঞ্জাম মোকাবিলায় রাশিয়ার কোনো সমস্যা হয়নি। এ বিষয়ে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও বেশির ভাগ পশ্চিমা বিশ্লেষক একমত হয়েছেন।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লেফটেনেন্ট জেনারেল ইগোর কোনাশেনকভ বলেছেন, সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে রুশ বাহিনী ৩৭৬ বিমান, ২০৩ হেলিকপ্টার, ২ হাজার ৯৪৪ ইউএভিএ, ৪০২ বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা, ৯৮৮ এমএলআরভি এবং ৩ হাজার ৮৯৮ আর্টিলারি বন্দুক ও মর্টার ধ্বংস করেছে। সেই সঙ্গে ৭ হাজার ৬১৪ ট্যাংক ও অন্যান্য সশস্ত্র যান ধ্বংস করেছে।
]]>