ফুটবলের রাজা পেলের ১০টি অজানা তথ্য
<![CDATA[
কয়েক বছর আগেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন ফুটবলের রাজপুত্র দিয়েগো ম্যারাডোনা। এবার ফুটবল হারাল তার সম্রাটকে। তিনি চলে গেলেন, আর ফিরবেন না। তবে ফুটবলপ্রেমীদের জন্য রেখে গেছেন স্মরণীয় অনেক মুহূর্ত।
১৯৫০ সালে বিশ্বকাপ আয়োজিত হয় ব্রাজিলের মাটিতে। লিগ পদ্ধতির সে আসরে অলিখিত ফাইনালে উরুগুয়ের বিপক্ষে হেরে দেশটির প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপার স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। মারাকানার সেই ফাইনাল এক শিশুর মনে দাগ কেটে যায়। পণ করেন এই শিরোপাটা একদিন ছুঁয়ে দেখবেন। ফুটবল পাগল ব্রাজিলিয়ানদের উপহার দেবেন শিরোপাটা। এর মাত্র ৮ বছর পর ১৭ বছর বয়সে সেদিনের শিশুটি কথা রেখেছিলেন। নায়ক হয়ে ব্রাজিলকে এনে দিয়েছিলেন বিশ্বকাপের ট্রফি। সেই স্বপ্নবাজ আর কেউ নন, ফুটবলের রাজা পেলে।
ক্যানসারের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই শেষে কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে বৃহস্পতিবার (২৯ ডিসেম্বর) না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন ফুটবলের রাজা। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে তার অর্জনগুলো ফুটবল বিশ্বে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু এই কিংবদন্তি সম্পর্কে এমন কিছু গল্প আছে, যা অনেকেই হয়তো জানেন না। পেলের বিদায় বেলায় বিবিসির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী চলুন জেনে নেয়া যাক এমন ১০টি ঘটনা।
ইউরোপীয় ক্লাবে কেন খেলেননি পেলে
ব্রাজিলের অন্যান্য অখ্যাত ও বিখ্যাত ফুটবলাররা বিদেশি ক্লাবে খেললেও পেলের ক্যারিয়ারের সোনালি সময়ে তাকে বাইরে খেলতে যেতে বাধা দেয়া হয়। পেলেকে নেয়ার জন্য সান্তোস এফসিকে প্রস্তাব দিয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ থেকে শুরু করে এসি মিলানের মতো ক্লাবও। সেসময় ফুটবলাররা কোন ক্লাবে খেলবেন সেই বিষয়ে তাদের কথা বলার সুযোগ ছিল খুব কম।
পেলেকে ব্রাজিলে রেখে দেয়ার জন্য চাপ ছিল সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও। ১৯৬১ সালে ব্রাজিলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জানিও কোয়াদ্রস পেলেকে ‘জাতীয় সম্পদ’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তাকে ‘রফতানি করা যাবে না’ বলে একটি ডিক্রি জারি করেছিলেন।
ব্রাজিলের এই ফুটবলার পরে অবশ্য একটি বিদেশি ক্লাবের হয়ে খেলেছিলেন। শুধু ১৯৭৫ সালে। সেই সময় তিনি যোগ দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফুটবল ক্লাব নিউইয়র্ক কসমসে।
৫০ বছর বয়সে ব্রাজিলের অধিনায়ক
পেলে তার পুরো ফুটবল ক্যারিয়ারে তার হাতে মাত্র একবারই অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পরেছিলেন। ক্লাব ও দেশের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করার জন্য তাকে যখনই প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল, সেটা তিনি সবসময় প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু এই ঘটনার ব্যতিক্রম হয় পেলের ৫০ বছর বয়সে।
সেটা ছিল ১৯৯০ সালের ঘটনা, জাতীয় ফুটবল থেকে অবসর নেয়ার ১৯ বছর পরে। সেই বছর ব্রাজিলের সঙ্গে বাকি বিশ্বের একটি প্রীতি ম্যাচ হয়েছিল মিলানে। তাতে অংশ নিয়েছিলেন পেলে। তার ৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই ম্যাচের আয়োজন করা হয়। প্রথমার্ধের ৪৫ মিনিট তিনি মাঠে ছিলেন। ওই ম্যাচে ব্রাজিল ২-১ গোলে হেরে যায়।
পেলে কি প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন
পেলে ১৯৯০ সালে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তিনি ১৯৯৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। কিন্তু সেটা আর হয়নি। তবে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন ঠিকই। ১৯৯৫ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এই তিন বছর তিনি ব্রাজিলের ক্রীড়া মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় তার নেতৃত্বে কিছু আইন তৈরি হয়েছিল। সেখানে পেশাদার ফুটবলারদেরকে ক্লাবের সঙ্গে দর কষাকষির ব্যাপারে কিছু ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল, যা তার নিজের প্রজন্মের ফুটবলারদের ছিল না।
আরও পড়ুন: না ফেরার দেশে পেলে
পেলে ভালো গোলরক্ষকও
ক্লাব ও দেশের বিকল্প গোলরক্ষক ছিলেন ছিলেন। আসল গোলরক্ষক আহত হলে তার জায়গায় তিনি নামতেন গোল ঠেকাতে। পুরো ক্যারিয়ারে পেলে সান্তোস এফসি ক্লাবের হয়ে চারবার গোলরক্ষকের গ্লাভস পরেছিলেন। ১৯৬৪ সালে ব্রাজিলিয়ান কাপের সেমিফাইনালেও তাকে গোলকিপার হতে হয়েছিল। তার টিম সবকটি খেলায় জয়লাভ করেছিল এবং পেলে একটি গোলও খাননি।
মাঠ থেকে বহিষ্কার
ঘটনাটি ১৯৬৮ সালের ১৮ জুনের। কলাম্বিয়ার রাজধানী বোগোতায় এক প্রীতি ম্যাচে কলাম্বিয়ান অলিম্পিক স্কোয়াডের মুখোমুখি হয়েছিল পেলের ক্লাব সান্তোস এফসি। সেই ম্যাচে কলাম্বিয়ার একজন ডিফেন্ডারকে ফাউল করা এবং রেফারির মতে ওই ফুটবলারকে অপমান করার কারণে পেলেকে মাঠ থেকে চলে যেতে বলা হয়েছিল। তখনো লাল কার্ডের প্রচলন হয়নি, যেটা শুরু হয় ১৯৭০ সালে।
তবে এই ঘটনায় মাঠের ভেতরে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। সান্তোসের ফুটবলাররা উত্তেজিত হয়ে রেফারি ভেলাসকোয়েজকে ঘিরে ধরেন। দর্শকরাও রেফারির ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছিল।
পেলে কি যুদ্ধ থামিয়েছিলেন
ষাটের দশকে বিশ্বের জনপ্রিয় ফুটবল ক্লাবগুলোর একটি ছিল পেলের সান্তোস এফসি। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে এই ক্লাবটি প্রীতি ম্যাচে অংশ নিতো। এই খ্যাতির কারণে তারা বাড়তি কিছু সুবিধাও পেয়েছিল।
এরকম একটি প্রীতি ম্যাচ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত নাইজেরিয়ায়, ১৯৬৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। বেনিন সিটিতে অনুষ্ঠিত ওই খেলায় সান্তোস ২-১ গোলে স্থানীয় একাদশকে পরাজিত করে। নাইজেরিয়াতে তখন রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ চলছিল। দেশ থেকে বায়াফ্রা রাজ্যটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে এই যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে।
ফুটবল ক্লাব সান্তোস এফসির ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন এমন একজন গবেষক গুইলহের্ম গুয়াশের মতে, এরকম একটি পরিস্থিতিতে নাইজেরিয়াতে খেলোয়াড়দের পাঠানোর ব্যাপারে ব্রাজিলের কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেক দুশ্চিন্তা ছিল। সেই কারণে বিবদমান পক্ষগুলো তখন যুদ্ধবিরতিতে যেতে সম্মত হয়।
আরও পড়ুন: পেলের যত রেকর্ড
পেলের সঙ্গে দেখা করতে বিটলসের ব্যর্থ চেষ্টা
নিউইয়র্ক কসমস ক্লাবের হয়ে খেলার জন্য ১৯৭৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যান পেলে। সেখানে ভাষা শেখার একটি স্কুলে তিনি ইংরেজি শিখতেন। কোনো একদিন ক্লাসের ফাঁকে সংগীত গোষ্ঠী বিটলসের জন লেননের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল।
তখন জন লেনন তাকে বলেছিলেন, ইংল্যান্ডে ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপ চলার সময় লেনন এবং বিটলসের অন্য শিল্পীরা হোটেলে গিয়ে পেলে ও দলের অন্যান্যদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ব্রাজিলের ফুটবল এসোসিয়েশনের পরিচালকরা অনুমতি দেয়নি।
পেলেকে ‘অপহরণ’
সান্তোস এফসি ক্লাবের ফুটবলাররা ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ত্রিনিদাদ ও টোব্যাগোতে খেলার ব্যাপারে খুশি ছিলেন না। কারণ সেই সময় সেখানে বড় ধরনের অশান্তি চলছিল। তবুও শেষ মুহূর্তে তারা খেলতে রাজি হয়েছিলেন। খেলার ৪৩ মিনিটের মাথায় গোল করে বসেন পেলে। তখনই সবকিছু বদলে যায়।
খেলা শেষে পোর্ট অব স্পেন স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে থাকা সমর্থকরা দৌড়ে মাঠের ভেতরে চলে আসে এবং পেলেকে কাঁধে নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে যায়। সেখান থেকে পেলেকে উদ্ধার করে আনতে বেশ কিছু সময় লেগেছিল।
সিলভেস্টার স্ট্যালোনের সঙ্গে সিনেমায় অভিনয়
১৯৮১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘এসকেপ টু ভিক্টরি’ সিনেমা অভিনয় করেছিলেন পেলেও। এই সিনেমায় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ের নাৎসি একাদশ ও বন্দীদের মধ্যে একটি কাল্পনিক ফুটবল ম্যাচের গল্প তুলে ধরা হয়। তার সঙ্গে ছিলেন ববি মুরের মতো আরও কয়েকজন পেশাদার ও সাবেক ফুটবলারও। ওই খেলায় গোলরক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করেন চলচ্চিত্রাঙ্গনে খ্যাতির তুঙ্গে থাকা সিলভেস্টার স্ট্যালোন। সিনেমার একটি দৃশ্যে পেলে অ্যাক্রোবেটিক বাইসাইকেল কিক নিয়েছিলেন। প্রথম শটেই তিনি এই কিকটি নিতে সফল হয়েছিলেন।
পেলে কি মাত্র একজনই
পেলে নামটি শুনলেই ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি ফুটবলারের কথাই চোখে ভেসে উঠে। ভক্তরা তাই আনন্দের সঙ্গে গান ধরতে পারেন ‘আছে মাত্র একজনই পেলে!’ কিন্তু আসলে এটি আক্ষরিকভাবে পুরোপুরি সত্য নয়।
তার জনপ্রিয়তার কারণে সারা বিশ্বে মাঠে ও মাঠের বাইরে এই নামের আরও অনেককেই পাওয়া যায়। আফ্রিকার বিখ্যাত ফুটবলারদের একজন আবেদি এইওর নাম হয়েছিল আবেদি পেলে। তিনি ঘানা ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি ক্লাবের হয়ে খেলেছেন। কেপ ভার্দের ডিফেন্ডার পেদ্রো মন্টেইরো যিনি ২০০৬ সালে ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটনে যোগ দিয়েছিলেন তিনিও পেলে নামে পরিচিত ছিলেন। এই ডাকনামটি তিনি পেয়েছিলেন তার শৈশবে।
কিন্তু ফুটবলার পেলের কী প্রভাব পড়েছিল ব্রাজিলের সমাজে সেটা বোঝা যায় পেলের আসল নাম এডসন থেকে। ব্রাজিলের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ভূগোল ও পরিসংখ্যান ইন্সটিটিউটের হিসাবে প্রচুর শিশুর নাম রাখা হয়েছে এডসন।
তারা বলছে, গত শতাব্দির পঞ্চাশের দশকে ব্রাজিলে ৪৩ হাজার ৫১১ জনের নাম ছিল এডসন। কিন্তু এর দুই দশক পর, পেলে যখন এক হাজারেরও বেশি গোল করেন এবং তিনটি বিশ্বকাপ জয় করেন, তখন এই নামের মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখ ১১ হাজারেরও বেশি।
]]>




