বিশ্বজুড়ে অতিধনীদের সম্পদ বৃদ্ধি ও বাংলাদেশের ধনীদের হালচাল
<![CDATA[
কোভিড ১৯-এর অভিঘাতে কাজ হারিয়ে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ যখন জীবিকার সংগ্রামে বিপর্যস্ত, বেকারত্বের প্রকটতা যখন আফ্রিকা ও এশিয়ার সীমানা অতিক্রম করে খোদ উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঢুকে পড়েছে এবং এমনি আরো নানা সংকটে পৃথিবীজুড়ে মানুষ যখন অস্তিত্বের সংকটে খাবি খাচ্ছে, ঠিক তখনই সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আর্থিক সেবাদানকরী প্রতিষ্ঠান ক্রেডিট সুসি’র উদ্ধৃতি দিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, গত দু’বছরে বিশ্বে অতিধনীর সংখ্যা ৫০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে (প্রথম আলো, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২)। অন্যদিকে ব্রিটিশ সাময়িকী ‘ইকোনমিস্ট’-এর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশ ভারতের অন্তত ২৩ কোটি মানুষ যেখানে দিনে ন্যূনতম ৩২ রুপি আয় করতে পারে না, সেখানে দেশটির অন্যতম শীর্ষ ধনী আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানির দৈনিক আয়ের পরিমাণ হচ্ছে ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
অন্যদিকে ব্রিটিশ সাময়িকী ‘ইকোনমিস্ট’-এর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশ ভারতের অন্তত ২৩ কোটি মানুষ যেখানে দিনে ন্যূনতম ৩২ রুপি আয় করতে পারে না, সেখানে দেশটির অন্যতম শীর্ষ ধনী আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানির দৈনিক আয়ের পরিমাণ হচ্ছে ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
উল্লিখিত দুটি খবরই বাংলাদেশের বর্তমান ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির গতিবিধি ও এর প্রবণতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পৃথিবীব্যাপী প্রায় সর্বত্রই অর্থনৈতিক মন্দা মানুষকে ব্যাপকভাবে কাবু করলেও বিশ্বের অতিধনীদের সম্পদের পরিমাণ যেমন মাত্র দুবছরেই ৫০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি করোনার কারণে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার এক লাফে ২০ শতাংশ থেকে ৪২ শতাংশে উন্নীত হওয়া সত্ত্বেও এবং ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে সৃষ্ট অসহনীয় মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠলেও এখানে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধি পাচ্ছে খুবই অস্বাভাবিক হারে, যা কোথাও কোথাও এবং কখনও কখনও আদানি, আম্বানি বা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অতিধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির হারকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, শুধু ২০২১ সালেই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের ধনীদের অর্থ জমা হয়েছে ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা, যা পূর্বে জমাকৃত পুঞ্জিভূত অর্থের তুলনায় ৫৫ শতাংশ বেশি (প্রথম আলো, ১৭ জুন ২০২২)। আর গত দুবছরে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অতিধনীদের সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে ৫০ শতাংশ হারে, যা পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে ভাবুন, বাংলাদেশে ধনীদের সম্পদ এখন কী হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে!
আরও পড়ুন: আইএমএফ ঋণ দুর্ভোগ কমাবে না বাড়াবে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জানুয়ারি-মার্চ ২০২২ সময়কালে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়েছে ১ হাজার ৬২১টি, অর্থাৎ প্রতিমাসে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ৫৪০ জন (আজকের পত্রিকা, ২৩ জুন ২০২২)। তো, যে দেশে করোনার কারণে এক বছরে দারিদ্র্যের হার ২২ শতাংশ বেড়ে যায়, সে দেশে কোটিপতির সংখ্যা মাসে ৫৪০ জন করে বৃদ্ধি পাওয়া অনেকটাই নির্মম শোনায় না কি?
তারপরও এটাই সত্য যে, দেশে এখন সেটিই ঘটছে এবং দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির সর্বশেষ গতিপ্রবণতা দেখে মনে হচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতের দিনগুলোতে তা আরও বৃদ্ধি পাবে। কারণ রাষ্ট্র এখন তাদেরই করতলগত এবং তাদের ইচ্ছাই রাষ্ট্রের ইচ্ছা। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্র তাদের পৃষ্ঠপোষকও। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা পরস্পরের প্রতিপালক এবং রক্ষাকর্তাও; অর্থাৎ ‘দেবে আর নেবে মিলাবে মিলিবে’-এই হচ্ছে তাদের মূল মন্ত্রণা। অবশ্য এ কবিতাংশটুকু রচিত হয়েছিল মানুষের মধ্যকার মিলনের আবেগ ও প্রয়োজনীয়তাকে বুঝাতে, যা এখন এ দেশে শুধু স্বার্থের ভাগাভাগি বুঝাতেও চমৎকার মিলে যাচ্ছে বৈকি! আর মিলবেই-বা না কেন, রাষ্ট্রের চাওয়াও-যে বর্তমানে অনেকটা এ রকমই।
ব্যাংকের খেলাপি ঋণ লাগামহীন হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে দেখে দেশের সচেতন নাগরিক মাত্রই ব্যাপকভাবে উদ্বিগ্ন হচ্ছেন। কিন্তু এটাতো এখন সর্বজনবিদিত যে, এ দেশে খেলাপি ঋণের মূল ভোক্তাই হচ্ছেন দেশের ধনিক শ্রেণি। তাহলে সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়া মানে ধনিক শ্রেণির আরও ধনী হয়ে ওঠা। আর খেলাপিঋণ বৃদ্ধির হার যেভাবে বাড়ছে, তাতে ধারণা করা যায় যে, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির সুবাদেও দেশে ধনীর সংখ্যা সহসাই আরও বৃদ্ধি পাবে এবং সেটাকেও রাষ্ট্র দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি হিসেবে দাবি করে বসে কিনা, সেটাই এখন দেখায় বিষয়। তবে রাষ্ট্র এটিকে সরাসরি উন্নয়ন ও অগ্রগতি হিসেবে দাবি না করলেও ঋণখেলাপিরাই-যে দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছেন, সে দাবিতো তারা হরহামেশাই করছেন। আর তা তারা করবেনই-বা না কেন?
আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি বা অন্য ধনীদের আয়ের পরিমাণ তেমন কোনো বর্ধিত বিনিয়োগ ছাড়াই হঠাৎ করে এতটা বৃদ্ধি পাওয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের মূল্যমান বেড়ে যাওয়াকে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটি অবশ্যই একটি বড় কারণ, তবে মূল কারণ নয় অবশ্যই। মূল কারণ হচ্ছে, নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও অর্থনীতির অন্যবিধ ক্রান্তিকালে ব্যবসায়ে একচেটিয়া মুনাফা অর্জনের সুযোগ গ্রহণের পৈচাশিক নিষ্ঠুরতা, যা এ পৃথিবীতে ঐতিহাসিক কাল ধরেই চলে আসছে। আর সেই একই সত্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। বাংলাদেশের ধনীদের সম্পদ গত এক দশক ধরেই অত্যন্ত দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধোত্তর সময়ে এ হার অতীতের যেকোনো সময়ের হারকেই ছাড়িয়ে গেছে, যার সাথে মিল আছে আদানি ও বিশ্বের অতিধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির সাম্প্রতিক উল্লম্ফনেরও। তবে পার্থক্য শুধু এই যে, বাংলাদেশের বিত্তবানেরা সম্পদের হিসাব লুকায়, লুকিয়ে কর ও শুল্ক ফাঁকি দেয়, আর বিদেশে অর্থপাচার করে গড়ে তোলে বেগমপাড়ার মতো সম্পদের সব নতুন স্থাপনা।
আদানিদের সাথে বাংলাদেশের ধনীদের আরও একটি পার্থক্য এই যে, আদানিরা পরিশ্রম করে, ঝুঁকি নিয়ে ও সাধারণভাবে প্রথামতো রাষ্ট্রকে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব যুগিয়ে নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে থাকেন। আর বাংলাদেশের বিত্তবানেরা পরিশ্রমের বদলে শ্রমশোষণ করে, ঝুঁকি গ্রহণের পরিবর্তে উল্টো রাষ্ট্রকেই ঝুঁকিতে ফেলে এবং রাষ্ট্রকে রাজস্ব যোগানোর পরিবর্তে বরং রাষ্ট্রের কাছ থেকেই ছলে-বলে-কৌশলে নানা অন্যায্য প্রণোদনা গ্রহণ করে নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে থাকেন। অবশ্য নেতিবাচক ও হতাশাব্যঞ্জক এসব পার্থক্যের তালিকা সহজেই আরও অনেক দীর্ঘ করা যাবে। তবে মূল কথা হচ্ছে, আদানি ও বিশ্বের অন্য শীর্ষ ধনীরা ব্যবসা করেন রাষ্ট্রের সহযোগী বিনিয়োগকারী হিসেবে। আর বাংলাদেশের অধিকাংশ ধনীরা ব্যবসা করেন রাষ্ট্রের বিনিয়োগকে অনৈতিক পন্থায় নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে রাতারাতি অগাধ বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার জন্য।
উপরোক্ত বক্তব্যসমূহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর এসব দেখে বাংলাদেশের বিত্তবানদের মধ্যে যে এ নিয়ে কোনোরূপ অনুশোচনা বা আত্মোপলব্ধি তৈরি হবে-এমনটি আশা করা একান্তই অবান্তর। কারণ তারা এটি ভালো করেই জানেন ও বুঝেন যে, এসব নীতিকথা কালোহাতে কালোটাকা অর্জনের জন্য কোনো কাজের কথা নয়। এবং এসব কথা না শুনলেও তাদের কিছুই আসে-যায় না। আর সুবিধাটি এই যে, রাষ্ট্র ও ধনীদের মধ্যকার সম্পর্কটি এখন এতোটাই নিবিড় যে, রাষ্ট্র নিজেই তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায় না। তো, রাষ্ট্র ও ধনীদের সম্পর্কের ধরনটি যখন এই, তখন সামনের দিনগুলোতে এ দেশে কালোটাকা নির্ভর ধনীদের সংখ্যা যে ক্রমাগত আরও বাড়তেই থাকবে এবং বর্ধনশীল থাকবে ঋণখেলাপি, অর্থপাচারকারী, সুইস ব্যাংকে গোপনে অর্থ জমাকারী ও বেগমপাড়ার উঠতি লুটেরারাদের সংখ্যা, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।
]]>