বাংলাদেশ

মহামান্য রাষ্ট্রপতির নির্দেশনায়ও টনক নড়ে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর

<![CDATA[

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ৫৩তম সমবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে যেয়ে গত ১৯ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টির আচার্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘কিছু উপাচার্য ও শিক্ষকের কর্মকাণ্ডে সমাজে শিক্ষকদের সম্মানের জায়গাটি ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে।..একজন উপাচার্যের মূল দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রমের তত্ত্বাবধান, পরিচালনা, মূল্যায়ন ও উন্নয়নকে ঘিরে। কিন্তু ইদানীং পত্রিকা খুললে মনে হয়, পরিবার-পরিজন ও অনুগতদের চাকরি দেওয়া এবং বিভিন্ন উপায়ে প্রশাসনিক ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নেওয়াই যেন কিছু উপাচার্যের মূল দায়িত্ব। অনেক শিক্ষকও বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিকে ঐচ্ছিক মনে করেন। বৈকালিক কোর্স বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়াকেই তাঁরা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন।’

 

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ নিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁর নিজের এরূপ কষ্ট ও হতাশার কথা এর আগেও একাধিকবার ব্যক্ত করেছেন। ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি প্রায় একই ধরনের কিছু বক্তব্য রেখেছিলেন যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখন দিনে সরকারি আর রাতে বেসরকারি চিত্র ধারণ করেছে।..এক শ্রেণির শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছেন, যেটি শিক্ষার সার্বিক পরিবেশকে বিঘ্নিত করছে।..এসব ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষার্থীরা কতটুকু লাভবান হচ্ছেন, এ ব্যাপারে প্রশ্ন থাকলেও এক শ্রেণির শিক্ষক ঠিকই লাভবান হচ্ছেন।’

মহামান্য রাষ্ট্রপতির ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বরের ঐ ভাষণের পর বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) তাৎক্ষণিকভাবে কিছুটা নড়েচড়ে বসেছিল বলেই মনে হয়েছিল। ঢাবি সমাবর্তনের মাত্র দু’দিন পর ১১ ডিসেম্বর তারা সান্ধ্যকোর্স বন্ধকরণসহ অন্যান্য কিছু বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেধে দিয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পত্র দিয়েছিল। উক্ত পত্রের প্রেক্ষিতে সংবাদমাধ্যমের চাপাচাপিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তখন তাৎক্ষণিকভাবে কিছু প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করা হয়, যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে অন্য দু’একটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকিদেরকে এ ব্যাপারে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখা যায়নি, যদিচ ইউজিসির পত্রের বিষয়টি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই প্রযোজ্য ছিল।

ইউজিসির ১১ ডিসেম্বরের উক্ত পত্রের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিক্রিয়ার ভাষা ও ধরন দেখে তখনই বুঝা গিয়েছিল যে, রাষ্ট্রপতির ভাষণ বা ইউজিসির চিঠি এসবকে তারা থোড়াই পাত্তা দেন। এ বিষয়ে ঢাবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেছিলেন, ‘একটি বিশ্ববিদ্যালয়তো কোনো ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগ বা কোর্স হঠাৎ করে খোলা বা বন্ধ করা যায় না।’ এর অর্থ হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি বা ইউজিসির কথায় তারা সান্ধ্যকোর্স বন্ধ করবেন না এবং তারা তা করেনও নি। উক্ত ঘটনার পর ইতোমধ্যে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সান্ধ্যকোর্সের বাণিজ্য যথারীতি এখনও বহাল আছে।

ঢাবির ৫২তম সমাবর্তনের দু’বছর পর ২০২১ সালের ১ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবারও চরম হতাশার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে প্রায় একই ধরনের আহ্বান জানান। তবে এ ভাষণে তিনি পূর্ববর্তী বক্তব্যসমূহের সাথে বিশেষভাবে যুক্ত করেন উচ্চশিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের প্রসঙ্গটিকে, যে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি খুবই নাজুক। এ ভাষণে তিনি দেশের উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে এ ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ নতুন করে ঢেলে সাজাবার পরামর্শ দেন। উক্ত ভাষণের পর ইউজিসিও গৎবাঁধা ভঙ্গিতে এ বিষয়ে কিছু লোকদেখানো উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল, যার মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা কার্যক্রম জোরদারকরণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু এ বিষয়ে অদ্যাবধি কোনো অগ্রগতি কি হয়েছে? ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনের তুলনামূলক তথ্যতো বরং এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতির অবনতি ঘটার বিষয়টিকেই তুলে ধরছে।

২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত ঢাবির ৫২তম সমাবর্তন, ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত শতবর্ষপূর্তি উৎসব ও ২০২২ সালের ১৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ৫৩তম সমাবর্তন–এ তিনটি অনুষ্ঠানেই মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের আচরণ, উচ্চশিক্ষার গুণগত মান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃত গৌরব ও ঐতিহ্যের বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে ও যথোচিত চেতনায় সকলের সামনে তুলে ধরেন। রাষ্ট্রের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে স্বাধীনতা-উত্তরকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রটি সবার চোখের সামনে কিভাবে পতনের গহ্বরে নিমজ্জিত হয়ে গেলো, সে সংক্রান্ত ভবিষ্যৎ মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদের ঐ তিনটি ভাষণই আগামীদিনে অনন্য গবেষণা-উপকরণ হয়ে থাকবে বলে ধারণা করা চলে। আর সেই সাথে এটিও অনুমান করা যায় যে, সেখান থেকে ওঠে আসবে এ অবলোকনও যে, একটি দেশের উচ্চশিক্ষিতদের মাথার পচন কতোটা পুঁতিগন্ধময় হলে তারা তাদের আচার্যের উদ্বেগ ও পরামর্শকে ঔদ্ধত্যের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে বলতে পারেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো হঠকারিতাপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়নি।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আচার্যই নন, একইসঙ্গে তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বেরও প্রতীক এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অভিভাবকও। বস্তুত তিনিই রাষ্ট্রের শীর্ষতম ‘প্রতিষ্ঠান’। ফলে রাষ্ট্রপতির উদ্বেগ ও পরামর্শকে উপেক্ষা করা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ ও প্রতিষ্ঠানকে অমর্যাদা করারই সামিল। কিন্তু শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্য যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সেটিই ঘটে চলেছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতির উপরোক্ত তিনটি ভাষণের বিপরীতে সংশ্লিষ্টদের প্রতিক্রিয়া এবং এ বিষয়ে গৃহীত ব্যবস্থাদির ধরন (যা অগ্রহণেরই সামিল) উল্লিখিত অমর্যাদার বিষয়টিকেই ফুটিয়ে তোলে। আর স্পষ্ট করে তোলে এ বিষয়টিকেও যে, রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয় ও সমর্থন কতোটা প্রকট ও নিষ্ঠুর হলে এরূপ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ প্রদর্শনকে তারা অন্যায় না ভেবে উপভোগ করেন।

 

]]>

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
error: Content is protected !!