বাংলাদেশ

যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব?

<![CDATA[

শক্তি চট্টোপাধ্যায় তার ভাবনা থেকে কবিতাটি লিখেছেন। কিন্তু তার ওই কবিতা পাঠকের মনে ভিন্ন ভাবনারও জন্ম দিতে পারে। আর মহান কোনো কাব্য সব সময়ই দ্যুতিময়, দ্যোতনাবাচক। প্রিজমের মতো। এর নানা রঙ। যে যেভাবে সেই রঙ গায়ে মাখবেন সেটা তার ব্যাপার। কিন্তু আলো ছড়ানোর কাব্য মানুষকে আলোকিত করবেই।

সাহিত্য আমার কাজ না। পাঠক হিসেবেও আমি ব্যাক বেঞ্চার। কিন্তু শক্তির এই কবিতা আমাকে শক্তি দেয়। মনে হয় মানুষ কখনোই নিঃশেষ হবার নয়। অমিত সম্ভাবনাময় মানুষের মুত্যুও সম্ভাবনা শেষ করতে পারে না। মানুষ চলে যায় কিন্তু তার পথ থেকে যায়। সেই পথ আরও নতুন পথ দেখায়। তাই মানুষের মৃত্যু নাই। সে শুধু সঞ্চারিত হয় এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে। এক যুগ থেকে আরেক যুগে। এক শতাব্দি থেকে আরেক শতাব্দিতে সভ্যতা এভাবেই এগিয়ে যায়।

হতাশার খবর গুলো শুনতে শুনতে মনে হতে পারে অর্থহীন এই জীবন। এই সমাজ। এই রাষ্ট্র। হতাশা জমিয়ে রাখলে তা আরও বড় হতাশার জন্ম নেয়। কিন্তু একটু  ভিন্ন চোখে তাকালেই দেখা যাবে যে জীবন আরামের, আয়েশের সেই জীবনের কোনো গল্প নেই। যে জীবন কষ্ট আর সংগ্রামের মুখোমুখি হয় না সেই জীবন ঢেউ হীন এক নদীর মতো। যেখানে ঢেউ নেই সেখানে আসলে জীবন নেই। নিশ্চল, নিরুত্তাপ, অচল। দূর থেকে সেটাকে স্বপ্নের জীবন মনে হলেই সেটা এক দুঃস্বপ্নের জীবন।

ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। যাচ্ছে পুরো মানবজাতি। আর এই যুদ্ধের প্রভাব এখন দেশে দেশে। যুদ্ধের সরাসরি শিকার হচ্ছেন ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ, নারী ও শিশু। এক বাংলাদেশি নারীকে আমি জানি। যিনি দীর্ঘদিন ধরে ইউক্রেনে আছেন। যুদ্ধের শুরুতে এক অনিশ্চিতের পথে পাড়ি জমিয়েছিলেন। ইউক্রেন ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন সপরিবারে। সম্প্রতি তিনি আবার কিয়েভে ফিরে এসেছেন তার নিজগৃহে। তিনি যাওয়ার সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার কান্না ভেজা অনুভূতি জানিয়েছিলেন। আবার ফেরার সময় তার উচ্ছ্বাসও তিনি প্রকাশ করেন। তিনি ইউক্রেনকেও তার স্বদেশ মনে করেন। তাই এখনো অনিশ্চয়তা থাকলেও ফিরতে পেরেই তিনি খুশি।

সাধারণ মানুষের এই অনুভূতি হয়তোবা শাসকদের স্পর্শ করে না। অস্ত্র ব্যবসায়ীদের নাড়া দেয় না। দখলদারদের দমাতে পারে না। তাইতো এখনও যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধ রাশিয়া চায়। আমেরিকাও চায়। ইউক্রেন হলো বলির পাঠা। যুদ্ধ ওই দুইটি দেশের কাছে এখন ব্যবসা।

আরও পড়ুন: অতি উৎসাহের ডান্ডাবেড়ি!

আর তাদের ব্যবসার শিকার সারা বিশ্ব। ইউরোপ থেকে অনেক দূরে এই বাংলাদেশও যুদ্ধের শিকারে পরিণত হয়েছে। অর্থনীতিতে তর তর করে এগিয়ে যাওয়া একটি দেশ, যার ২০২৬ সালে গ্রাজুয়েট হওয়ার কথা সেই বাংলাদেশের গতিও টেনে ধরছে যুদ্ধ। নিত্যপণ্যের দাম, ডলার সংকটসহ নানা অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব পড়ছে নাগরিকদের ওপর। শিশুর খাদ্যেও টান পড়েছে।

মোড়লরা নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু তাদের কোনো সংকট হয় না। কারণ তাদের সুবিধা বজায় রেখেই তা দেয়। কিন্তু খাদ্য পায় না বাংলাদেশ। জ্বালানি তেল পায় না। ভোজ্যতেলও নয়। পায় না ডলার।

এই মোড়লিপনা দেশেও আছে। আছে বিত্তবান আর বিত্তহীন। আছে ক্ষমতাবান আর ক্ষমতাহীন। তাই তো ৩০ হাজার টাকা ঋণের দায়ে কৃষকের কোমরে দড়ি বেঁধে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু হাজার কোটি টাকা ঋণ খোলাপিকে নতুন করে আবারও ঋণ নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। কাজ না করে ব্যাংকের টাকা চুরি করে দেশের বাইরে পাচার করেন কেউ কেউ। তারা সেখানে বাড়ি করেন। বিলাসী জীবনের আয়োজন করেন। পৃথিবীতেই তারা যেন স্বর্গ দেখেন। আবার কেউ কেউ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ঘাম ঝরিয়েও দুই বেলা খাবার জোগাড় করতে পারেন না। শিশুর জন্য দুধের বরাদ্দ কমিয়ে দিতে হয়। মাংস খাদ্য তালিকা থেকে বিদায় করতে হয়। বাজারের ব্যাগে মাছ ঢুকিয়ে হিসেব না মেলায় তা আবার বাজারেই রেখে আসতে হয়।

রমজান মাসকে সামনে রেখে এখনই নানা আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। ডলার সংকটে পণ্য ঠিকমতো আসবে তো? তবে যারা ব্যবসা করেন তাদের কেউ কেউ যেন সংকটেই ব্যবসা খোঁজেন। যুদ্ধের বাজারে আঙ্গুল ফুলে যেমন কলাগাছ হয় কেউ কেউ। রমাজানের বাজারে আগেই থেকেই কেউ কেউ কলাগাছ হতেন। এবার আশঙ্কা করি কেউ কেউ বটগাছ হয়ে যাবেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ আরও চাপে পড়বে। তাদের জন্য নরক নামিয়ে আনা হবে। তাদের অবস্থা হবে হর রোজ রোজার মতো।

এক বৈপরিত্যের সমাজ ও রাষ্ট্র। এখানে করোনা আসে। জীবনের ভয়ে ঘরে ঢুকে যায় মানুষ। তবে কেউ কেউ পেয়ে যায় মওকা। করোনার বাজার পরিণত হয় যুদ্ধের বাজারে। তাই আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বাড়ে। কোটিপতি বাড়ে। বিপরীত দিক থেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নাগরিকের সংখ্যাও বাড়ে। শহর বাড়ে, শহরে কান্নাও বাড়ে।

এই দেশে পদ্মা সেতু আছে। নগরে আছে মেট্রোরেল। এখানে দামি ব্যক্তিগত গাড়িও বাড়ছে। আবার বাড়ছে পায়ে হাঁটা মানুষ। ওই মানুষগুলো জানেন না কতটা পথ হাঁটলে তাদের পথিক বলা হবে। কতটা পথ পেরোলে তার দম নেয়ার সময় আসবে।

এই শহরে আমি এসেছি ৩৪ বছর। মাধ্যমিক পাস দিয়ে পিরোজপুর থেকে একা এসেছি। সঙ্গে কেউ ছিল না। ছিল শুধু বাবার সাবধান বাণী। তাইতো মাঝনদীতে লঞ্চ ঝড়ে পড়লেও টিনের বাক্স এবং ট্রাভেল ব্যাগ হাতছাড়া করিনি। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে চাঁদপুর থেকে লঞ্চ যখন ঢাকা আসবে না বলে জানিয়ে দেয়া হয় তখন সেই টিনের বাক্স মাথায় নিয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে নিজেই স্টেশনে নেমে যাই। ভয় ছিল অন্যের কাছে দিলে যদি চুরি হয়ে যায়, লুট হয়ে যায়।

আরও পড়ুন: শীতের ঢাকায় ‘লু-হাওয়া’

এখনো ঢাকা শহরে আমি ভয়ে ভয়ে হাঁটি। কথা বলি সাবধানে। কারণ কেউ যদি পথ বন্ধ করে দেয়! কেউ যদি কথার ভুল ধরে! এখানে এখন জীবন আর সরল অংক নয়। নানা হিসেবের জীবন। তারপরও এই শহর এখনো আমার হয়েছে বলে মনে হয় না। নিজেকে আগন্তুকই মনে হয়। করোনার সময় অনেককে শহর ছাড়তে দেখেছি। ২০ বছর ঢাকায় থাকার পর কেউ সংসার সন্তান নিয়ে নিজ  গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তারা কান্না আটকে ছল ছল চোখে বলেছেন, ‘এই শহর আমার হলো না।’

এই জনপদে আরও অনেক আগন্তুক আছেন। ঢাকার জনসংখ্যা তাই দিনে বাড়ে, রাতে কমে যায়। এ এক মায়ার শহর, যাদুর শহর। এই শহর মানুষের অনেক কিছুই কেড়ে নিচ্ছে। আমার সন্তানের শৈশব কেড়ে নিয়েছে। আমার সারল্য কেড়ে নিয়েছে। আমার স্ত্রীর চোখে জল আনছে। এটা আমাকে কষ্ট দেয়। আমাকে তাড়িত করে। এই তাড়নাই আমাকে আবার এক সবুজ জীবনের স্বপ্ন দেখায়।

সে কারণেই আশা ছাড়ি না। আশা করি একদিন যুদ্ধ থেমে যাবে। একদিন সব শিশু খাবার পাবে। কৃষকের কোমরে ঋণের দায়ে দড়ি বাঁধা হবে না। দেশের টাকা বাইরে পাচার হবে না। ব্যাংকগুলো লুট হবে না। আমার স্বপ্নগুলো সজীব হয়ে উঠবে।

সেই দিন আসুক আর না আসুক প্রত্যাশা করেই যাব। স্বপ্ন দেখেই যাব। স্বপ্নবাজ মানুষের জয় হবেই। সামনের বছরে। সামনের যুগে। নয়তো আগামী শতাব্দিতে। সুসময় আসবেই। কারণ মানুষের স্বপ্ন কেউ,  কোনো লুটেরাই লুট করতে পারে না। লুটেরাদের সাময়িক সাফল্য কখনোই এত মানুষের শুভ চিন্তাকে সব সময়ের জন্য পদনত রাখতে পারে না।

সব মানুষকে কিছু সময়ের জন্য বোকা বানানো যায়। কিছু মানুষকে সব সময়ের জন্য বোকা বানানো যায়; কিন্তু সব মানুষকে সব সময়ের জন্য বোকা বানানো যায় না। আব্রাহাম লিঙ্কনের এই কথা শক্তি যোগায়। বাঁচতে শিখায়। তাই, যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব? কেন আমি পলায়নপর হব? কেনইবা আমরা হতাশ হয়ে জীবনেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করব!

আরও পড়ুন: সারাহ মরে গিয়েও দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন

‘ভাবছি, ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো।
এতো কালো মেখেছি দু হাতে
এতোকাল ধরে!
কখনো তোমার ক’রে, তোমাকে ভাবিনি।
এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
চাঁদ ডাকে: আয় আয় আয়
এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
চিতাকাঠ ডাকে : আয় আয়
যেতে পারি
যে-কোন দিকেই আমি চলে যেতে পারি
কিন্তু, কেন যাব?
সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাব
যাব
কিন্তু, এখনি যাব না
তোমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাব
একাকী যাব না, অসময়ে।’

(শক্তি চট্টোপাধ্যায়)

লেখক: সাংবাদিক

]]>

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
error: Content is protected !!