যেভাবে ডলার হলো অর্থনৈতিক হাতিয়ার
<![CDATA[
বলা হয়ে থাকে, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ডলার। বিশ্বের অর্থনীতিতে শক্তিশালী এ দেশটি তাদের মুদ্রার মান দিয়ে নিমেষেই ঘুরিয়ে দিতে পারে বৈশ্বিক হালচাল, যার আঁচ ইতোমধ্যে টের পাচ্ছে বিশ্বের সিংহভাগ দেশ।
সময়টা ছিল ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসেন শিল্পোন্নত ১০টি দেশের অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরা। উদ্দেশ্য ছিল- নিজেদের মধ্যে সহজ বিনিময়ের জন্য অভিন্ন এক মুদ্রাব্যবস্থা চালু করা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের হাত ধরে বিশ্ববাজারে ডলার হয়ে ওঠে একমাত্র প্রভাবশালী মুদ্রা। ১৯৭১ সালে নিক্সন সরকারের স্বর্ণের ওপরে ভিত্তি করে ডলারের মান নির্ণয়ের নীতি থেকে সরে আসা ও ১৯৭৪ সালে সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তি করে ডলারকে পেট্রোডলারের রূপ দেয়ার সিদ্ধান্ত পাল্টে দেয় ডলারের স্বরূপ।
ইংরেজি যেমনি লম্বা সময় যুক্তরাজ্যের উপনিবেশিকতাবাদের মধ্য দিয়ে হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক ভাষা, তেমনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যুক্তরাষ্ট্রের ‘মার্শাল প্ল্যান’ ও ‘পেট্রোডলার’ এর বদৌলতে আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে ডলার হয়ে ওঠে অনন্য। আশির দশক থেকে এখন পর্যন্ত ডলারকে ধরা হয় সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মুদ্রা। যেখানে অন্য মুদ্রা, সোনা কিংবা শেয়ারের দাম ওঠানামা একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার, সেখানে ডলারের দাম অনেকটাই স্থিতিশীল থাকায় এটিকে সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আরও পড়ুন: বন্ড মার্কেটে বেহাল দশা, বিকাশে বাধা কোথায়?
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পণ্য বেচাকেনায় ডলার সর্বপ্রচলিত মাধ্যম হওয়ার সুবিধা অনেকক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে থাকে। বিশেষ করে চলতি বছরের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার ওপরে পশ্চিমাদের আরোপিত হাজারখানেক নিষেধাজ্ঞা ও সুইফট থেকে রাশিয়াকে বের করে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার মূলে ছিল- ডলার বাজারে অর্থনৈতিকভাবে রাশিয়াকে পঙ্গু করে দেয়া।
একদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের লাভের গুঁড়, অন্যদিকে ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার বৃদ্ধিতে ডলারের মান বেড়েছে আশাতীত হারে। বিশেষ করে বহু বছর পর ডলার ইউরো ও পাউন্ডকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে সামনে। চলতি বছরের আগস্টে প্রতি ডলারের বিপরীতে ইউরোর মান দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৯৯৩৫। চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রতি ইউরোর বিপরীতে ডলারের মান ছিল ১ দশমিক ১৫। ইউরোপের মন্দা, রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞা ও চীনের জিরো কোভিড নীতির মধ্যে ডলারের ঊর্ধ্বমুখী ভাব প্রমাণ করছে- বিশ্ব বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ডলার।
এদিকে ডলারের এমন বেপরোয়া আচারণের আঁচ লেগেছে বাংলাদেশের বাজারেও। চলতি বছরের জুলাই থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ডলার বাজারে বিরাজ করেছে চরম অস্থিরতা। ব্যাংকে ডলার কিনতে গিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। খোলাবাজারে ডলারের দাম উঠেছিল ১২০ টাকা পর্যন্ত, যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
পরবর্তীতে ডলার বাজার সামাল দিতে নিজেদের কর্মতৎপরতা বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলোতে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি মানি এক্সচেঞ্জগুলোর ওপরেও আরোপ করা হয় নানা কিসিমের বিধিনিষেধ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তে বেঁধে দেয়া হয়েছিল ডলারের দাম, আন্তঃব্যাংকিং ডলার বেচাকেনার ওপরে দেয়া হয়েছিল নানা বিধি-নিষেধ ও মানি এক্সচেঞ্জগুলো যাতে প্রতি ডলারে ৫০ পয়সার বেশি লাভ করতে না পারে সে বিষয়ে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
এদিকে ডলারের এমন একচেটিয়া প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে ইতোমধ্যে বিশ্বের অনেক শক্তিধর দেশ নিজস্ব মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থাকে জোরদার করছে। রাশিয়া জানিয়েছে, ইউরোপকে তারা ডলারে নয়, রুবলে গ্যাস দেবে, চীন ইউয়ানকে শক্তিশালী করতে তোড়জোড় চালিয়ে যাচ্ছে, ভারত রুপির অবমূল্যায়ন ঠেকাতে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
যদিও অনেকেই বলছেন, ডলার নিভে যাওয়ার আগে এই শেষবারের মতো দপ করে জ্বলে উঠেছে। কিন্তু পারিপার্শ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করলে সহজেই বোঝা যায়, ডলার দিন শেষ হতে এখনও ঢের সময় বাকি।
]]>