বিনোদন

যেভাবে সৃষ্টি হলো এই পরিস্থিতি

<![CDATA[

গত রোববার (৮ জানুয়ারি) ব্রাজিলের কংগ্রেস তথা পার্লামেন্ট ভবন, সুপ্রিম কোর্ট ও প্রেসিডেন্টের বাসভবনে হামলা চালায় সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোর কয়েক হাজার সমর্থকরা। জাতীয় পতাকার রঙের পোশাক পরে তারা দেশটির মূল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। এ হামলাকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ক্যাপিটল হিল’ স্টাইলের হামলার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এমনটা কেন ঘটল? কিভাবে সৃষ্টি হলো এ পরিস্থিতি?

তিন মাসের আগের তিক্ত নির্বাচন

এখন থেকে প্রায় তিন মাস আগে গত বছরের (২০২২) অক্টোবরে ব্রাজিলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন উগ্র-ডানপন্থী হিসেবে খ্যাত সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো ও সাবেক প্রেসিডেন্ট বামপন্থী নেতা লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা। নির্বাচনে উভয় পক্ষই জোরালো প্রচারণা চালায়। তাতে ঘটে কাদা ছোড়াছুড়ির ঘটনাও। দু’দফার নির্বাচনে সামান্য ভোটের ব্যবধানে বলসোনারোকে হারিয়ে দেন লুলা।

নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে পারেনি পরাজিত সাবেক প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর সমর্থকরা। আর তাই যুক্তরাষ্ট্রের ‘ক্যাপিটল হিল’ স্টাইলে হামলার পরিকল্পনা করে তারা। গত ১২ ডিসেম্বর নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে বলসোনারোর পরাজয় ঘোষণার দিনই রাজধানী ব্রাজিলিয়াতে কেন্দ্রীয় পুলিশ সদর দফতর দখলে নেয়ার চেষ্টা করে তারা।

সংবাদ মাধ্যমগুলো জানায়, বোলসোনারোর সমর্থকরা ব্রাজিলের জাতীয় ফুটবল দলের ঐতিহ্যবাহী হলুদ রঙের জার্সি গায়ে পুলিশ সদর দফতরে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। কাছাকাছি অনেক বাস ও গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। এ সময় সমর্থকদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ স্টান গ্রেনেড ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে।
 

লুলার অভিষেক ঘিরেও দাঙ্গার আশঙ্কা দেখা দেয়। আর তাই বলসোনারোরা সমর্থকদের ভয়ে নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয় পুরো দেশ। রাজধানী ব্রাসিলিয়ায় যত পুলিশ ছিল, সব মোতায়েন করা হয় অভিষেক অনুষ্ঠানের নিরাপত্তায়। অবশেষে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে চলতি বছরের প্রথম দিনে এক জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো দেশের শাসনভার নেন ৭৭ বছর বয়সী রাজনীতিবিদ লুলা।

অভিষেক অনুষ্ঠানে হামলা চালাতে না পারলেও ঠিকই হামলা চালালো বলসোনারো সমর্থকরা। রাষ্ট্রীয় ভবনে হামলার এ ঘটনা ‘অভূতপূর্ব’ বলে মন্তব্য করেছেন প্রেসিডেন্ট লুলা। সেই সঙ্গে হামলাকারীদের ‘ধর্মান্ধ ফ্যাসিস্ট’ আখ্যা দিয়ে কঠোর শাস্তির দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তিনি। বলসোনারোর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাঙ্গাবাজদের উসকানি দেয়ার অভিযোগও করেছেন তিনি। তিনি বলেছেন, ‘সবাই জানে সাবেক প্রেসিডেন্টের এমন অনেক বক্তব্য রয়েছে যা এটিকে উৎসাহিত করছে’।

গভীর রাজনৈতিক বিভাজন

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রাজিলের জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। জনগণ প্রধানত দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। জনগণের একাংশ মনে করছে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো আর তাদের প্রতিনিধিত্ব করে না। আর তাই তারা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সহিংস হামলা করতেও প্রস্তুত। ব্রাজিলের কংগ্রেস, সুপ্রিম কোর্ট ও প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে হামলার ঘটনা সেটাই প্রমাণ করেছে।

আরও পড়ুন: ব্রাজিলে ভয়াবহ দাঙ্গা, আটক ১৫০০

বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি শুধু ডান বনাম বামের লড়াই নয়। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফল গ্রহণ করতে যারা অস্বীকৃতি জানায় তারা নিজেদের ক্ষোভ এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর ঝাড়ছেন। যারা দাঙ্গায় অংশ নিচ্ছেন তারা এই জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে উগ্র অংশ। তবে লুলার বিরোধিতা করা এমন অনেকেই আছেন যারা মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দাঙ্গার আগুন উসকে দিচ্ছেন।

কারাবন্দী থেকে প্রেসিডেন্ট

লুলা এর আগে এক মেয়াদ প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর তিনি কারাদণ্ডও ভোগ করেছেন। ব্রাজিলে কেউ কেউ মনে করেন কারাগার থেকে তার প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে চলে আসা এক ‘লজ্জাজনক’ ঘটনা।

লুলা ২০১৭ সালে দুর্নীতির অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর ৫৮০ দিন কারাগারে ছিলেন। এ কারণে ২০১৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়। ওই নির্বাচনে জয়ী হন বলসোনারো।

কিন্তু এবার নির্বাচনের আগে লুলার সাজা বাতিল ঘোষণা করা হয় ও নির্বাচনে দাঁড়ানোর পথে যেসব বাঁধা ছিল সেগুলোও দূর হয়ে যায়। তবে লুলার অনেক সমালোচক মনে করেন ব্রাজিলের সর্বোচ্চ আদালত তার সাজা খারিজ করে দিলেও তার অর্থ এই নয় যে তিনি নির্দোষ ছিলেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে আইনি প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে তার সাজা বাতিল হয়েছে।

অন্যদিকে লুলার সমর্থকরা মনে করেন, রাজনৈতিক উদ্দেশে লুলার বিরুদ্ধে এই মামলা করা হয়েছে। পরে ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্ট যখন রায় দেয় যে এই মামলার বিচারক, যিনি পরে বলসোনারোর সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন, নিরপেক্ষ ছিলেন না, তখন লুলার সমর্থকদের ধারণা আরও জোরালো হয়ে ওঠে।

পরাজয় মানতে অনিচ্ছুক বলসোনারো সমর্থকরা 

জাইর বলসোনারোর বহু সমর্থক তাকে একজন ‘ত্রাতা’ হিসেবেই দেখেন। তাদের বিশ্বাস, ‘ঈশ্বর, পিতৃভূমি ও পরিবার’ নামের যে তিন মূল্যবোধ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোকে তিনিই রক্ষা করেন। আর বামপন্থি লুলাকে তারা এসব মূল্যবোধের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখেন। তাদের আশা ছিল, বলসোনারো এবারও এই হুমকিকে পরাজিত করতে পারবেন। লুলা নির্বাচিত হলে তিনি দেশের গির্জা বন্ধ করে দেবেন এমন গুজবও ছড়িয়েছিল।

যারা ভেবেছিলেন লুলা নির্বাচনে পরাজিত হবেন তারা তার জয় মেনে নিতে পারেননি। আর তাই অনেকেই সামরিক ব্যারাকের সামনে ক্যাম্প করে সেনাবাহিনীর প্রতি লুলার জয় ঠেকানোর আহবান জানান। এতে যদি সামরিক অভ্যুত্থান হয় তবে তাতেও তারা রাজি ছিলেন। তবে সেনাবাহিনী এতে সাড়া দেয়নি এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী লুলা প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে লুলা

লুলা প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে প্রবেশ করায় বলসোনারো সমর্থকদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। লুলার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করে সেসময় যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান বলসোনারো। এর ফলে বলসোনারোর সমর্থকদের মধ্যে জমাট বাধা ক্ষোভ আরও তীব্র হয়।

লুলাকে যারা ‘ব্রাজিলের প্রতি কমিউনিস্ট হুমকি’ হিসেবে দেখেন তাদের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। সেনাবাহিনীর প্রতি হতাশ হয়ে এবার তারা পরিস্থিতি নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যেসব প্রতিষ্ঠান শুধু তাদের প্রতিনিধিত্ব করে না এবং তাদের মূল্যবোধকে রক্ষা করে না সেসবে তারা হামলা চালান।

চরমপন্থা, গুজব ও ভুয়া তথ্য

জাইর বলসোনারোর বিভাজনমূলক বক্তব্য ও ব্রাজিলের নির্বাচনী ব্যবস্থার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা ব্রাজিলের বর্তমান পরিস্থিতিকে উসকে দিতে অনেকটাই সাহায্য করেছে। নির্বাচনের আগে তিনি বারবার অভিযোগ করেছেন, ব্রাজিলের ইলেকট্রনিক ভোটিং (ইভিএম) ব্যবস্থায় জালিয়াতির ঝুঁকি রয়েছে। তার এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে দেশটির নির্বাচনী কর্তৃপক্ষ।

আরও পড়ুন: নব্য ফ্যাসিবাদীদের বিচার হবে: লুলা

তবে অনেক ব্রাজিলীয়র বিশ্বাস, নির্বাচন ‘চুরি’ করা হয়েছে যদিও বলসোনারোর রাজনৈতিক দলের দায়ের করা চ্যালেঞ্জ প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে নির্বাচনী আদালত। দাঙ্গা শুরুর পর টুইটারে এক বার্তায় দাঙ্গায় উসকানি দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বলসোনারো।

‘সরকারি ভবনে লুটতরাজ ও অনুপ্রবেশের’ যে ঘটনা ঘটেছে তাকে বেআইনি বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি। তবে হামলাকারীদের চরমপন্থি আচরণ এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে একটি নিজস্ব সত্ত্বা হয়ে দাঁড়িয়েছে যেটিকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

]]>

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Check Also
Close
Back to top button
error: Content is protected !!