এখন দেশে ই-কমার্স প্রতারণা নিয়ে হই চই হচ্ছে। গ্রহকরা টাকা ফিরে পেতে রাস্তায় নেমেছেন। দায় নিয়ে বাকযুদ্ধ চলছে দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে । আইন নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। কিন্তু সমাধানের পথ এখনো অধরা। গ্রাহকদের টাকা ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই কোথাও। সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত অবস্থা।
দায় দায়িত্ব নির্ধারণ করা যাবে। প্রতারকদের শাস্তিও হয়তো হবে। শেষ পর্যন্ত রেগুলেটরি বডিও হয়তো হবে। কিন্তু গ্রাহকদের টাকার কী হবে? তারা কি টাকা ফেরত পাবেন? এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগে আমি কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই।
১. উৎপাদনের অর্ধেক দামে কীভাবে পণ্য বিক্রি সম্ভব ?
২. কীভাবে দ্বিগুণ ক্যাশব্যাক সম্ভব ?
৩. এক বছরে কীভাবে দ্বিগুণ, তিনগুণ মুনাফা দেওয়া সম্ভব ?
৪. একজন ক্রেতা আটটি মোটরসাইকেল দিয়ে কী করবেন ?
৫. জুয়া খেলে টাকা হারালে তার দায় কে নেবে ?
৬. প্রতারণার শুরুতে রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো কেন ঘুমিয়ে থাকে ?
ইভ্যালির রাসেলের মুক্তির দাবিতে কিছু লোক এখন মাঠে নেমেছেন। তাদের বিশ্বাস রাসেলকে ছেড়ে দিলে তারা তাদের টাকা ফেরত পাবেন। অর্থমন্ত্রী এই প্রতারণার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়তে দায়ি করেছেন। আর বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন গ্রেপ্তার করে এই সমস্যার সমাধান হবে না। তাহলে কীভাবে সমাধান হবে?
যারা মুক্তির দাবি করছেন তাদের বিশ্বাসের ভিত যে দুর্বল তারা তা নিজেরাও জানেন। কিন্তু তাদের আশার মধ্যেও লোভ কাজ করছে। তারা মনে করছেন, রাসেল মুক্তি পেলে তারা হয়তো তাদের টাকা বা পণ্য পেয়ে যাবেন। বাকীদের যা হয় হোক। কিন্তু রাসেল টাকা দেবেন কীভাবে । তার তো এক হাজার কোটি টাকার দেনার বিপরীতে সম্পদ আছে ৬৫ কোটি টাকা।
তাকে ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা চালাতে দিলে টাকা আসবে, কিন্তু দায়ের গ্যাপ আরও বাড়বে। কিছু লোক টাকা পাবে, কিন্তু না পাওয়ার সংখ্যা আরও বাড়বে। এই যারা মুক্তির জন্য মাঠে নেমেছেন তারা এখন নতুন লোভে আরো অনেক গ্রাহক প্রতারিত হওয়ার বিনিময়ে তাদের টাকার উশুল চাইছেন।
ডেসটিনি আর ইভ্যালির পদ্ধতি এক নয়। কিন্তু লোভ আর প্রতারণার কৌশল এক। ডেসটিনির মাল্টি লেভেল মার্কেটিং পদ্ধতিতে একটি পণ্য কেনার পর তিনি যদি নতুন দুইজন গ্রাহক বা ক্রেতা আনতে পারতেন তাহলে সেখান থেকে তিনি লাভ পেতেন। নতুন এই দুইজন আরও চারজন ক্রেতা আনবেন তাহলে প্রথমজন এই চারজনের কাছ থেকেও লাভ পাবেন। মধ্যবর্তী দুইজনও পাবেন। এভাবে অনন্তকাল লাভের ওপর লাভ চলতে থাকবে। যা বাস্তবে অসম্ভব। আর এই লোভে ক্রেতার কাছে পণ্যটির উপযোগিতা আর মুখ্য থাকেনি। মুখ্য হয়েছে ব্যবসা। ক্রেতা হয়ে উঠেছেন ব্যবসায়ী। ফলে পণ্যটির দামও গুরুত্বহীন হয়ে ওঠে। পিরামিড জুয়ায় পণ্যটি একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
এবার আসি ইভ্যালির জুয়া প্রসঙ্গে। দুই লাখ টাকার একটি মটর সাইকেল তারা অফার করে এক লাখ টাকায়। উৎপাদক কিন্তু ইভ্যালির কাছ থেকে দুই লাখ টাকাই নেবে। তাহলে ইভ্যালি এক লাখ টাকায় কীভাবে বিক্রি করবে? হিসাবটি সহজ। তারা এই অফারে ৫০০ জনের কাছ থেকে এক লাখ করে টাকা নেবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে মোটরসাইকেল দেবে ১০০ জনকে। বাকি ৪০০ জনের টাকা তাদের কাছে থেকে যাবে। যে ১০০ জন মোটরসাইকেল পাবেন তারা তা প্রচার করবেন। আর এই প্রচারে নতুন অফার করবে ইভ্যালি। হাজার লোকের কাছ থেকে টাকা নেবে, ক্ষুদ্র অংশকে পণ্য দেবে। কৈয়ের তেলে কৈ ভাজবে। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠান এই পদ্ধতিতে কত টাকা পুঁজির বিপরীতে কত দেনার ভার বহন করতে পারবে তার একটি বৈজ্ঞানিক হিসাব আছে। সেই হিসাব করে তারা বিনিয়োগ করেনি। তারা মনে করেছে এটা অনন্তকাল ধরে চলবে। আর এরমধ্যেই তারা অন্যের পকেটের টাকা দিয়ে স্বাভাবিক ব্যবসায় ফিরে আসবে। যা অসম্ভব।
এই অর্ধেক দামে পণ্য অফারে গ্রাহকের দিক থেকে যে ঘটনা ঘটেছে তা হলো তারাও কেউ কেউ ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন। তারা মনে করেছেন অর্ধেক দামে একটি মোটরসাইকেল পেলে তো সেটা আবার বিক্রি করে বেশ লাভ হবে। তাই দুই-একটি পণ্য পাওয়ার পর তারা প্রয়োজন না থাকলেও একজন আটটি মোটরসাইকেল বা ১০টি ফ্রিজের জন্য টাকা দিয়েছেন। ভেবেছেন বড় ব্যবসা পাওয়া গেছে। কিন্তু এখন দেখছেন ব্যবসা তো দূরের কথা জমা দেওয়া টাকাই পাওয়া যাচ্ছে না। এখানে কাজ করেছে লোভ।
সম্প্রতি আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। সেটা হলো পিরোজপুরের এহসান গ্রুপের প্রতারণা। তারা সুদমুক্ত হালাল ব্যবসার কথা বলে ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তারাও ব্যবসার মাধ্যমে বেশি লাভের লোভ দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এখানেও একই পদ্ধতি। ১৭টি সাইনবোর্ড সর্বস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আবার সেই টাকা দিয়ে গ্রাহককে লাভ দিয়েছে। লাভের খবরে লোভী মানুষ কোনো চিন্তা না করেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। কিন্তু এক পর্যায়ে তারা আর লাভ দিতে পারেনি। আর মূল টাকা ফেরত চাইলে ঘটে বিপত্তি। টাকা ফেরত দিবে কীভাবে? তারা তো পরের ধনে পোদ্দারী করেছে।
আরও ১০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানও একই কাজ করেছে। আরও নতুন নতুন প্রতারক প্রতিষ্ঠানের নাম জানা যাচ্ছে। ই-অরেঞ্জ তো টাকা পাচারই করে দিয়েছে। ডেসটিনির সময়ও আরও অনেক এমএলএম ব্যবসা গজিয়ে উঠেছিল। আমরা যুবক ও ইউনি পে টু ইউ’র মতো আরও প্রতারক প্রতিষ্ঠানের নাম জানি। মামলা হয়েছে। আটকও হয়েছে। কিন্তু প্রতারিতরা টাকা ফেরত পায়নি। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য মতে ২০০৬ সাল থেকে এপর্যন্ত নানা ধরনের ব্যবসার নামে প্রতারকরা ২১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ ও এহসান গ্রুপের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৬ ও ৪২০ ধারায় মামলা হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতারণা বা আর্থিক প্রতারণার মামলা এই দুইটি ধারাতেই হয়। ৪০৬ ধারায় বিশ্বাস ভঙ্গের অপরাধ। যার সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড। আর ৪২০ ধারায় প্রতারণা ও আর্থিক প্রতারণা। যার সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড। এই মামলায় প্রতারকরা হয়তো শাস্তি পাবেন। কিন্তু গ্রাহকরা কী টাকা ফেরত পাবেন? সোজা উত্তর হলো- না।
তাহলে উপায়? দেশে প্রচলিত যে আইন আছে, তাতে প্রতারিতরা টাকা ফেরত পেতে দেওয়ানি মামলা করতে পারেন। কিন্তু এই মামলা করে টাকা ফেরত পাওয়া দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। অনেকেরই ধৈর্য থাকে না। আর মামলা তো প্রমাণ করতে হবে। যদি দুদক মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করলে ব্যাংক একাউন্ট এবং সম্পদ জব্দ করতে পারে। সেখান থেকে গ্রাহক টাকা পেতে পারেন। কিন্তু গ্রাহককে টাকা পেতে প্রমাণ করতে হবে সম্পদে বা একাউন্টে তার টাকা আছে। আর কোম্পানি দেউলিয়া ঘোষণা করলে শেয়ার হোল্ডার হিসেবে গ্রাহকদের তালিকা করে সম্পদ এবং অর্থ তারা পেতে পারেন।
ফৌজদারি মামলায় অপরাধ প্রমাণ হলে রাষ্ট্র সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে পারে। অনেক কিছুই পারে। কিন্তু পথের দূরত্ব তো অনেক। আর গ্রাহকের পাওনা টাকার পরিমাণের সমান সম্পদ বা টাকা তো থাকতে হবে। তা না হলে গ্রাহকে কীভাবে তার টাকা ফেরত দেওয়া হবে! আর মামলা শেষ না হওয়ার আগে তো কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনো বিধান নেই। রাষ্ট্রকে দায়বদ্ধ করা যায় এমন কোনো আইন নাই। এসব কারণেই ডেসটিনি, যুবক, ইউনি পে টু ইউর প্রতারিত গ্রাহকরা আজও টাকা ফেরত পাননি।
তাহলে রাষ্ট্রের কী কোনো দায় নেই? রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো প্রতারণা বন্ধ করা শুরুতেই। আর নাগরিকদের প্রতারণা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া। তাদের অর্থের সুরক্ষা করা। যখন নীতিমালা ও স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসিডিউর (এসওপি) করা হলো তার আগেই হাতিয়ে নেওয়া শেষ। উল্টো তার আওতায় প্রতারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চলতে দেওয়া হচ্ছে। আর এই প্রতারকরা দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করেছে। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। ফলে সাধারণ মানুষ তাদের বিশ্বাস করেছে। লোভের ফাঁদ তৈরিতে তারাও সহায়তা করেছেন।
এই ধরনের প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় নীতি ও আইনের বাইরে হতে পারে না। যদি আইন ও নীতির মধ্যে হয় তাহলে গ্রাহকদের সুরক্ষারও বিধান থাকবে। প্রতিষ্ঠান কত টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে কত দায় নিতে পারবে তাও নির্দিষ্ট থাকবে। সেই আইন করা না হলে এই ধরনের প্রতারণা চলতেই থাকবে। একটি বন্ধ হবে, নতুন নামে আরেকটি আসবে। আর লোভের ফাঁদে পা দেবেন হাজার হাজার মানুষ।