শাহ আব্দুল করিমের শিল্পকর্মের মাধ্যমে গভীর জীবনদর্শন প্রকাশ পেয়েছে: ড. শরদিন্দু ভট্টাচার্য
<![CDATA[
শাহ আব্দুল করিম উনাকে দুইভাবে মূল্যায়ন করা যায়। এক হচ্ছে ব্যক্তি জীবনদর্শন আরেক হচ্ছে কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার (অর্থাৎ তিনি ব্যক্তি মানুষ আরেক তার শিল্পকর্ম)। এই শিল্পকর্মের মধ্যে তার জীবনদর্শনও থাকে। বাউল শাহ আব্দুল করিমের শিল্পকর্মের মাধ্যমে গভীর জীবনদর্শন প্রকাশ পেয়েছে মন্তব্য করেছেন লোকসাহিত্য গবেষক ও সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. শরদিন্দু ভট্টাচার্য।
শাহ আবদুল করিমের ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সময় সংবাদকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এইসব বলেন।
অধ্যাপক শরদিন্দু ভট্টাচার্য বলেন, শাহ আবদুল করিমের শিল্প-সাফল্যের কথা বলতে গেলে তার গানের কথা সহজ-সরল। একটি আলাদা দর্শন তার গানগুলোতে লুকিয়ে আছে। তাঁর গানগুলোর মাধ্যমে তিনি একটি বাণী প্রচার করেছেন।
তিনি আরও বলেন, শাহ আবদুল করিমকে বাউল বলা হয়। বাউল যারা তাদের মাঝে একইসঙ্গে সূফী ও বৈষ্ণব মতবাদের মিশ্রণের প্রভাব আছে। এই মিশ্রিত দর্শনের মতবাদটি একটি অসাম্প্রদায়িক। একজন বাউল অসাম্প্রদায়িক নাও হতে পারেন। তবে বাউল আবদুল করিম ব্যক্তি মানুষ হিসেবে সর্বদা অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। এজন্য জীবনদশায় তাকে অনেক দুঃখ, দুর্দশা ও দুর্গতির সম্মুখীন হতে হয়েছে।
শরদিন্দু ভট্টাচার্য বলেন, আবদুল করিমের গানের ভাষায় মানুষকে মানুষ ভাবনার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ওপর আবদুল করিমের অনেক প্রত্যাশা ছিল। ভাঁটি অঞ্চলে নিরক্ষরতার মাধ্যমে বেড়ে ওঠায় শিক্ষিত ও নগরজীবনের মানুষের প্রতি আবদুল করিমের এই প্রত্যাশা বেশি কাজ করতো। তার দৃষ্টিতে আমাদের বাইরের সবকিছু সুন্দর হচ্ছে, জামা-কাপড় সুন্দর হচ্ছে, ক্ষমতা বাড়ছে, কিন্তু আমাদের ভেতরটা যেনো শুকিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃত শিক্ষিত ও সভ্য হতে হলে মানুষের মন সুন্দর হতে হবে। এই ভাবনাটা একটি বিরাট দর্শন। যা আবদুল করিম চিন্তা করতেন একইসঙ্গে গান ও লেখনীতে প্রকাশ করতেন।
আরও পড়ুন: শাহ আবদুল করিমকে হারানোর ১৩ বছর
তিনি বলেন, শাহ আবদুল করিমের বড় সফলতা হচ্ছে বিজ্ঞ লোকের কাছে যেমন গ্রহণযোগ্যতা তিনি পেয়েছেন তেমনি সাধারণ লোকের কাছেও একইভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন। তার নিজের কণ্ঠে গান বেশিরভাগ মানুষই শোনেনি। তবে তার লেখা গানগুলো অন্য কণ্ঠে শোনে সাধারণ মানুষ আবদুল করিমকে স্মরণ করে। আমরা যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত তারা আবার আবদুল করিমকে অন্যভাবে চিনে থাকি। বর্তমানে লোকসাহিত্যের এই জায়গাতে আবদুল করিমের জীবনদর্শন নিয়ে গবেষণাও হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, লোকসাহিত্য গবেষকদের-সরকারের উচিৎ দেশের মূল জনগোষ্ঠীর নিকট শাহ আব্দুল করিমের সঠিক দর্শন ও গানগুলো প্রচার করা, টিকিয়ে রাখা। বাউল আবদুল করিম আমাদের নিজের সম্পদ, এই বাংলাদেশের সম্পদ। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রই তাদের নিজেদের লোকসাহিত্যের প্রাচীন দিকগুলো এখনো সংরক্ষণ রেখেছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে শাহ আবদুল করিমকে পরিচয় করিয়ে দিতে নিজেদের দায় নিতে হবে, সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
শাহ আবদুল করিম ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইব্রাহিম আলী ও মা নাইওরজান। দারিদ্রের সঙ্গে আজন্ম যুদ্ধ ছিল তার। কৃষি কাজের পাশাপাশি রচনা করেন কালজয়ী সব লোকগান। সমাজের নানা কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সুরে সুরেই প্রতিবাদ জানিয়েছেন আজীবন।
দারিদ্র ও জীবন সংগ্রামের মাঝে বড় হওয়া শাহ আবদুল করিমের সঙ্গীত সাধনার শুরু ছেলেবেলা থেকেই। বাউল সম্রাটের প্রেরণা তার স্ত্রী, যাকে তিনি আদর করে ‘সরলা’ নামে ডাকতেন। ১৯৫৭ সাল থেকে শাহ আবদুল করিম পাশের উজানধল গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ, প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তার গান কথা বলে সব অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। সুনামগঞ্জের কালনী নদীর তীরে বেড়ে উঠা শাহ আবদুল করিমের গান শুরুতেই ভাটি অঞ্চলে জনপ্রিয় হলেও শহরের মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পায় তার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে কৃষিকাজে বাধ্য হলেও কোনো কিছুই তাকে গান রচনা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
আরও পড়ুন: সংরক্ষিত হলো শাহ আবদুল করিমের ৪৭২ গান
গানের মধ্যে প্রাণের সন্ধান পাওয়া শাহ্ আবদুল করিম রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদকসহ (২০০১) পেয়েছেন কথা সাহিত্যিক আবদুর রউফ চৌধুরী পদক (২০০০), রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার (২০০০), লেবাক অ্যাওয়ার্ড, (২০০৩), মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার (২০০৪), সিটিসেল-চ্যানেল আই আজীবন সম্মাননা মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস (২০০৫), বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি সম্মাননা (২০০৬), খান বাহাদুর এহিয়া পদক (২০০৮), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা (২০০৮), হাতিল অ্যাওয়ার্ডস (২০০৯), এনসিসি ব্যাংক এনএ সম্মাননা ইত্যাদি।
শাহ আবদুল করিম লিখেছেন ও সুর দিয়েছেন ১৬শর বেশি গানে, যেগুলো সাতটি বইয়ে গ্রন্থিত আছে। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে তার ১০টি গান ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে।
তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে আফতাব সঙ্গীত, গণ সঙ্গীত, কালনীর ঢেউ, ধলমেলা, ভাটির চিঠি, কালনীর কূলে, শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্র উল্লেখযোগ্য। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ৯৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন শাহ আবদুল করিম।
]]>