সামরিক দিক থেকে তুরস্ক কতটা শক্তিশালী
<![CDATA[
সৌদি আরব ও ইরানের মত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ তুরস্ক। পশ্চিমা জোট ন্যাটোর একমাত্র মুসলিম দেশ। তুরস্কের সেনাবাহিনী ন্যাটো জোটের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। এছাড়াও দেশটির রয়েছে শক্তিশালী ড্রোন বাহিনী। তবে বিপুল অস্ত্রের ভান্ডার থাকলেও পারমাণবিক কোনো অস্ত্র নেই তুরস্কের হাতে।
১৯৮০’র দশকে বেশ কয়েকটি ন্যাটো সদস্য দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজেরাই সমরাস্ত্র তৈরির উদ্যোগ নেয়। তুরস্ক তার মধ্যে অন্যতম। প্রতিরক্ষা খাতে বিদেশ নির্ভরতা কমিয়ে নিজ দেশেই প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা সামগ্রী উৎপাদনের বিশাল পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করে আঙ্কারা। বেশ সফলও হয়।
সমর শক্তিবিষয়ক আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইট গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের ২০২২ সালের র্যাংকিংয়ে বিশ্বে সামরিক শক্তির দিক থেকে তুরস্কের অবস্থান ১৩তম। ন্যাটো মিত্রদের মতই সামরিক প্রযুক্তিতে উন্নত আঙ্কারা।
তুরস্কের সেনাবাহিনী
তুরস্কের সেনাবাহিনী ন্যাটো জোটের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। সংখ্যার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পরই যার অবস্থান। তুরস্কে বর্তমানে ৭ লাখের বেশি সেনা ও আধা সামরিক সদস্য রয়েছে।
তুরস্কের নৌবাহিনী
তুর্কি নৌবাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৪৮ হাজারের বেশি। এই বাহিনীর যুদ্ধসরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে ১৬টি ফ্রিগেট, ছোট আকারের যুদ্ধজাহাজ ৯টি, সাবমেরিন ১২টি। রয়েছে ৩ হাজারের বেশি ট্যাঙ্ক, ১৩ হাজারের বেশি সাজোয়া যান, নয়শোর বেশি স্বচালিত বন্দুক ও এক হাজারের বেশি কামান। এছাড়া ১২’শর বেশি বিমান, ৩’শর বেশি যুদ্ধবিমান, দেড় শতাধিক মানববিহীন আকাশযান, ৩শ’র বেশি প্রশিক্ষক বিমান ও ৬শ’র বেশি হেলিকপ্টার।
আরও পড়ুন: তুরস্কের মধ্যদিয়ে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের প্রস্তাব পুতিনের
শক্তিশালী ড্রোন
তুরস্কে বসবাসরত স্বাধীন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক আরদা মেভলুতোগলু বলেন, আঙ্কারার সরকার গত ২০ বছরে একটা শক্তিশালী ড্রোন বাহিনী গড়ে তুলেছে। এর মধ্যে অন্যতম, বায়রাক্তার টিবিটু ড্রোন। এটি এমন এক ধরনের যুদ্ধাস্ত্র যা গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও নজরদারিসহ হামলায় অংশ নিতে সক্ষম। এতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ইলেক্ট্রো-অপটিক্যাল ক্যমেরা আছে। তার সাথে আছে ডাটা-লিংক সিস্টেম এবং দুই থেকে চারটি বিস্ফোরক, যেগুলো উড়ে গিয়ে নির্ভুল নিশানায় আঘাত হানতে পারে।
তুরস্কের বাইকার টেকনোলজি কোম্পানি ২০১৪ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে বায়রাক্তার টিবি-টু ড্রোন উৎপাদন ও বিক্রি শুরু করলেও রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে এই ড্রোন বিশেষ নজর কেড়েছে। এই ড্রোন ব্যবহার করেই রাশিয়ার মস্কভা যুদ্ধজাহাজ, অস্ত্রের গুদাম, কয়েকটি কমান্ড সেন্টার এবং রাশিয়ান লক্ষ্যবস্তুতে সফলভাবে হামলা চালায় কিয়েভ।
ড্রোনটি ঘণ্টায় ১২৯ কিলোমিটার থেকে শুরু করে ২২২ কিলোমিটার গতিতে উড়তে পারে। তবে এসব ড্রোনের একটি দুর্বল দিক হলো এগুলো আকারে বড় আর তুলনামূলক কম গতিসম্পন্ন। একেকটি ড্রোন অন্তত ১০ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যে বিক্রি করে থাকে তুরস্ক।
আঙ্কারার রয়েছে শক্তিশালী কার্গি কামিকাজি ড্রোন। এর সফটওয়্যারসহ সবকিছু তুরস্কেই তৈরি ও ডিজাইন করা। ২০১৮ সালে প্রথমবার এটি উড়ানো হয়েছিল। ড্রোনটি শত্রুপক্ষের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও রাডার ধ্বংস করার পাশাপাশি সারফেস টু এয়ার তথা ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য মিসাইল ব্যবস্থাও ভেদ করতে সক্ষম।
এই ড্রোন ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অত্যাধুনিক এফ-সিক্সটিন ফ্যালকন, মানুষবিহীন বিমান আই.এ.আই হিরনসহ তিনটি প্রিডেটর ড্রোন রয়েছে তুরস্কের। গোকতুর্ক-এক ও গোকতুর্ক-দুই নামে দুটি গোয়েন্দা স্যাটেলাইটও রয়েছে।
কোন কোন দেশে রয়েছে তুরস্কের ড্রোন?
ড্রোন বিক্রির ক্ষেত্রে তুরস্কের গ্রাহকের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। তুরস্কের রফতানি সংক্রান্ত তথ্যে ড্রোনের সংখ্যা সুনির্দিষ্টভাবে বলা নেই। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, সিরিয়া ও লিবিয়ার সংঘাতে এবং সম্প্রতি নাগারনো কারাবাখের যুদ্ধে বায়রাক্তার টিবিটু ড্রোনের কার্যকর প্রয়োগ দেখা গেছে।
এরপরই এই ড্রোনের চাহিদা বেড়ে যায়। আফ্রিকার বাজারেও রয়েছে তুরস্কের দাপট। সেখানে চীনা উৎপাদকদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে আঙ্কারা। তুরস্কের ড্রোনের দাম কম অন্যদিকে, এসব অস্ত্রবাহী ড্রোনের পারফরম্যান্স ও মান ন্যাটোভূক্ত দেশগুলোর সমতুল্য। তুরস্কে সামরিক চুক্তিগুলোর বিস্তারিত খুব বেশি প্রকাশ করা হয় না। তবে তুরস্ক গত বছর ইথিওপিয়ার সাথে একটি প্রতিরক্ষা-সহযোগিতা চুক্তি করেছে এবং তাদের রফতানিও অনেকখানি বেড়েছে বলে জানা যায়।
তুরস্কের অস্ত্র কারা কেনে?
অপেক্ষাকৃত কমদামে মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করায় অনেক দেশই তুরস্কের প্রতিরক্ষা সামগ্রী কিনতে আগ্রহী। মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব এশিয়া এমনকি ন্যাটো সদস্য দেশের কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে আঙ্কারা। বর্তমানে তুরস্কের সমরাস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা মধ্য এশিয়ার দেশ তুর্কমেনিস্তান। দেশটি তুরস্ক থেকে সবচেয়ে বেশি কেনে সামরিক নৌযান।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে তুর্কি সমরাস্ত্রের বড় ক্রেতা কাতার। সবার আগে তুরস্কের বায়রাক্টার টিবি টু ড্রোন যায় কাতারের কাছে। দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর কাছে এ ধরনের ৬টি ড্রোন রয়েছে। তুরস্কের অস্ত্র কেনার তালিকায় আরও রয়েছে কাজাখস্তান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিন্স। দক্ষিণ এশিয়ায় তুরস্কের সমরাস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা পাকিস্তান।
আরও পড়ুন: তুরস্কে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে ৮৩ শতাংশ
পরমাণু অস্ত্র নেই
শক্তিশালী ড্রোন ও অস্ত্র ভান্ডার থাকলেও কোনো পরমাণু অস্ত্র নেই তুরস্কের হাতে। ১৯৮০ সালে পরমাণু অস্ত্রবিস্তার রোধ চুক্তিতে সই করে আঙ্কারা। ১৯৯৬ সালে বিস্তৃত পরমাণু পরীক্ষা নিষিদ্ধ চুক্তিতেও সই করে দেশটি। চুক্তিতে যে কোনো উদ্দেশে পরমাণবিক বিস্ফোরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তুরস্ককে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে হলে ‘পরমাণু অস্ত্রবিস্তার রোধ’ চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কিন্তু সেটি করলে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের যে ধরণের প্রতিক্রিয়ার মুখে দেশটিকে পড়বে তা মোকাবিলা করার ক্ষমতা এরদোয়ান সরকারের নেই বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র না থাকার আক্ষেপও কম নয় তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘বেশ কয়েকটি দেশের পারমাণবিক ওয়ারহেডসহ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। কিন্তু আমাদের নেই। এটি কোনোভাবেই মানা যায় না। বিশ্বে এমন কোনো উন্নত দেশ নেই, যারা এই অস্ত্রের মালিক না।’
এরদোগানের ভিশন
তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম লক্ষ্য হলো সামরিক অংশীদারত্ব। শুরুতে সাজোয়া যান দিয়ে শুরু করলেও এখন ট্যাঙ্ক, মিসাইল, রকেট লঞ্জার, ড্রোন সব কিছুই তৈরি হচ্ছে তুরস্কের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে।
তুরস্কের অনেক সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা বিশ্বমানের পণ্য উৎপাদান করে। দেশটি এখন স্থল, নৌ এবং আকাশ যুদ্ধের অনেক সামরিক যান, প্রযুক্তি ও যন্ত্রাংশ রফতানিও করে। সুযোগ পেল পরমাণু অস্ত্র তৈরিতেও তুরস্ক পিছিয়ে থাকবেনা বলে মত সমর বিশ্লেষকদের।
দেশের প্রতিরক্ষা খাতকে আরও স্বনির্ভর করতে ভিশন-২০২৩ হাতে নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। আর এই ভিশনে, তুরস্কের গণতন্ত্র ও উন্নয়নে বিদ্যমান ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি রাজনীতি ও অর্থনীতিতে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র হওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে।
]]>




