১০ জানুয়ারির ভাষণ: বঙ্গবন্ধুর দেশ গঠনের রূপরেখা
<![CDATA[
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের অবিসংবাদী নেতা। ১৯৭১ সালের বেশির ভাগ সময় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরেন তিনি। সেদিনই রাজধানীর বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন তিনি। তার সেই ভাষণ ছিল দেশ ও জাতি গঠনের রূপরেখা নির্দেশক।
বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি তার ভাষণের মাধ্যমে যে বিষয়টি সবার আগে উল্লেখ করতে চেয়েছেন তা হলো, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতি গঠন। ভাষণের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের শিকার সবার আত্মার শান্তি কামনা করেন। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন সবাইকে নিয়ে জাতি গঠনের কাজে নামতে। তারও আগে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল অন্তর্ভুক্তিমূলক। তাই অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি জাতি গঠনে তার নির্দেশনাও ছিল সুস্পষ্ট।
বঙ্গবন্ধুর ১০ জানুয়ারির ভাষণ থেকে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তা হলো, বিশ্বদরবারেও বাংলাদেশকে একটি নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে পরিচিত করিয়ে দেয়া, মজলুম মানুষের পক্ষ নেয়া। বঙ্গবন্ধু সেদিন তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের জনগণকে, আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের সামরিক বাহিনীকে, আমি মোবারকবাদ জানাই রাশিয়ার জনগণকে, আমি মোবারকবাদ জানাই জার্মানি, ব্রিটিশ, ফ্রান্স সব জায়গার জনগণকে। তাদের আমি মোবারকবাদ জানাই, যারা আমাকে সমর্থন করেছেন। আমি মোবারকবাদ জানাই আমেরিকার জনসাধারণকে, মোবারকবাদ জানাই সারা বিশ্বের মজলুম জনগণকে যারা আমাদের এই মুক্তি সংগ্রামে সাহায্য করেছে।’
আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধু যখন দেশে ফিরলেন…
এ থেকে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট। আর তা হলো, বঙ্গবন্ধু কোনো দেশ নয়; বরং দেশের জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কে বিশ্বাসী ছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল, জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কই এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সম্পর্ক দৃঢ় করে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও এ বিষয়টির একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি যে দুর্বল নয়, ১০ জানুয়ারির ভাষণে সে বিষয়টিও স্পষ্ট করেন তিনি।
নতুন স্বাধীন দেশের পক্ষ থেকে দেশি-বিদেশি কুচক্রীদের সতর্ক করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র সহ্য করা হবে না। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, ‘মনে রাখা উচিত বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে, বাংলাদেশকে কেউ দমাতে পারবে না। বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে লাভ নাই।’
বঙ্গবন্ধুর ভাষণে আরেকটি বিষয় ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো তার নেতৃত্ব। তিনি রাজনীতিবিদ থাকাকালেও যেমন জনগণের সঙ্গে অবলীলায় মিশেছেন, তেমনি রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি একইভাবে মিশতে চেয়েছেন। সেদিনের ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম ভাই হিসেবে। নেতা হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়।’ তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষকে ভালোবাসলে তা ফেরত পাওয়া যায়। তাই তিনি শাসক হিসেবে নয়, ভাই-বন্ধু হিসেবে মানুষের পাশে থাকতে চেয়েছিলেন। তার এই বক্তব্যই যেন ছিল আগামী দিনের রাজনৈতিক নেতাদের জন্য পথনির্দেশক।
সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে কী করণীয়, সে বিষয়েও নির্দেশনা ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণে। সবার আগে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি এ দেশের যুবক যারা আছে তারা চাকরি না পায়।’
আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার পরই স্বাধীনতা অর্জন পূর্ণতা পায়: প্রধানমন্ত্রী
এ ছাড়া উৎপাদন বজায় রাখা, প্রশাসন চালু ও কার্যকর রাখার নির্দেশনাও ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণে। দেশ গঠনে তিনি সবার সহযোগিতা চেয়ে বলেছিলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, যথেষ্ট কাজ পড়ে রয়েছে। আমার সকল জনগণকে দরকার। যেখানে রাস্তা ভেঙে গিয়েছে, নিজেরা রাস্তা করতে শুরু করে দাও। আমি চাই, জমিতে যাও, ধান বুনো, কর্মচারীদের বলি, একজনও ঘুষ খাবেন না। মনে রাখবেন, তখন সুযোগ ছিল না, কিন্তু আমি অপরাধ ক্ষমা করব না।’ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রতি দেশ গঠনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, সামনে তাকে কোন বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সচেতন হতে হবে, সে বিষয়ে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, এ নিয়ে তার নিজস্ব চিন্তাও ছিল। ১০ জানুয়ারির ভাষণে এই মন্তব্য তার সুচিন্তিত ভাবনারই ফসল। দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, নারীদের সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার, বেকারত্ব হ্রাসই ছিল তার প্রধান চ্যালেঞ্জ। বঙ্গবন্ধু সফলতার সঙ্গেই তার সামনে থাকা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। শুধু কি তাই? বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে কোথায় দেখতে চাইতেন, তারও ইঙ্গিত ছিল ভাষণে।
তিনি বলেছিলেন, ‘নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা। বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে, বাংলার মানুষ মুক্ত হয়ে বাস করবে বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে এই আমার সাধনা, এই আমার জীবনের কাম্য।’ সোজা কথায়, তার ভাষণে উঠে এসেছিল দারিদ্র্য-ক্ষুধা-শোষণ-নিপীড়নমুক্ত বাংলাদেশের কথা। সোনার বাংলার কথাই তুলে ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
সবচেয়ে মৌলিক বিষয় রাষ্ট্রের গঠন, চরিত্র কেমন হবে তা-ও বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণে নির্দেশিত ছিল। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার রাষ্ট্রে হবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই বাংলাদেশ হবে গণতান্ত্রিক, এই বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।’ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি তিনি সেদিনই পরিষ্কার করেছিলেন।
আরেকটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর তা হলো জাতীয় ঐক্য। সদ্য স্বাধীন দেশটি তখনও ধ্বংসস্তূপ। চারদিকে হাহাকার। স্বজন হারানোর কান্না তখনও থামেনি। প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি অপ্রতুল। সেই মুহূর্তে দেশে সবচেয়ে বেশি জরুরি ছিল জাতীয় ঐক্যের। সেদিনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে বলেছিলেন, ‘একদিন বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। একদিন বলেছিলাম, যার যা কিছু আছে তা নিয়ে যুদ্ধ করো। বলেছিলাম, এ সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম; এ জায়গায়ই ৭ মার্চ। আজ বলছি, তোমরা ঠিক থাকো, একতাবদ্ধ থাকো, কারো কথা শুনো না।’
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা স্পষ্টতই ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের রূপরেখা। রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে এমন কোনো মৌলিক দিক নেই যার কথা সেই ভাষণে উঠে আসেনি। বঙ্গবন্ধুর ১০ মার্চের ভাষণ তাই আজও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পথনির্দেশক।
]]>