Feni (ফেনী)ফেনী

৬ ডিসেম্বর ফেনী মুক্ত দিবস : সবাই ছুটছিল ফেনী কলেজ বধ্যভূমিতে

ফেনী | তারিখঃ December 5th, 2022 | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 164 বার

নিজস্ব প্রতিনিধি->>

৬ ডিসেম্বর ফেনী মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এইদিনে ফেনীতে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এসেছিল প্রতিক্ষিত ‘মুক্তি’। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে ফেনীতে উদিত হয়েছিল স্বাধীনতার প্রথম সূর্য। এইদিন সকাল থেকে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা ২নং সাব সেক্টর কমান্ডার ও ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক লে. কর্নেল জাফর ইমামের (তৎকালীন ক্যাপ্টেন, বীর বিক্রম) নেতৃত্বে দলে-দলে উচ্ছ্বসিত জনতা লাল-সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে চারদিক থেকে ফেনী শহরে প্রবেশ করে।

মুক্ত ফেনীতে মানুষের দৃষ্টি ছিল ফেনী কলেজে। একদিন আগে পাকিস্তানি আর্মি কলেজ ক্যাম্পাস ছেড়ে দেয়। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ক্যাম্প ও বহু শহীদের রক্তে রঞ্জিত বধ্যভূমি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ফেনী কলেজের তৎকালীন দর্শন বিভাগের শিক্ষক মুজিুবর রহমান বলেন, মাঠের একদম দক্ষিণের গোলপোস্টের নিচে অনেক লাশ পেয়েছি। এক কোণে ২০-২৫ টা লাশ দেখেছি। লাশ মানে হাড়গোড়। ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে সাংবাদিকরা গিয়ে ছবি তুলে এনেছে। কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক কোন তথ্য নেই। তবে এখানে অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে হত্যা করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। গোলপোস্টের পেছনের অংশ ছাড়াও মাঠ লাগোয়া রেলওয়ের ডোবাতেও লাশ পঁচে-গলে ছিল। এখন যেখানে অডিটরিয়াম রয়েছে সেখানেও মানুষের কঙ্কাল মিলেছিল।

ফেনী কলেজ বধ্যভূমি প্রসঙ্গে ফেনী ইউনিভার্সিটির ডেপুটি রেজিস্ট্রার শাহ আলম বকুল বলেন, তখন স্কুলে পড়ি। ৬ ডিসেম্বর সকালে মানুষ ছুটছিল ফেনী কলেজের পেছনের অংশে। তাদের দেখে আমিও ছুটলাম। কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধারা কলেজের ভেতরের মাঠে ঢুকতে দিচ্ছিল না। তখন মাস্টারপাড়ার ভেতর দিয়ে কলেজের পেছন দিক দিয়ে ঢুকি। দেখতে পাই, মাঠের দক্ষিণ গোলপোস্টে ফাঁসির দড়ি ঝুলে আছে। ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো পড়ে আছে। তীব্র পঁচা গন্ধে কাছে যাওয়া কষ্টকর হচ্ছিল। এখানে অনেকে ঝুলিয়ে নির্যাতন করে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল বলে পূর্বেই শুনেছিলাম। মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে হত্যার কথাও শুনেছিলাম। একাত্তরের অক্টোবরে একদিন ফেনী রাজাঝির দিঘির পূর্ব পাড় দিয়ে সন্তপর্ণে যাওয়ার সময় ফেনী পাইলট হাই স্কুলের বাস্কেটবল মাঠে খাঁচায় বন্দী বাঘ দেখেছিলাম। বাইরে থেকে জাল দিয়ে খাঁচা ঢেকে রাখা হয়েছিল।

বধ্যভূমি প্রসঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব বলেন, যুদ্ধ শেষে কলেজের ভেতরের অংশে অসংখ্য মানুষের হাড়গোড় পাওয়া যায়। তবে কাদের এখানে এনে হত্যা করা হয়েছে তা অজানা রয়ে গেছে।

বধ্যভূমি প্রসঙ্গে ফেনী কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ, ফেনী ইউনিভার্সিটির কোষাধ্যক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক তায়বুল হক বলেন, জানুয়ারির শুরুতে কলেজের বর্তমান শহীদ মিনারের বেদীর পাশে স্তুপাকৃত মানুষের হাড়গোড়-খুলি দেখেছি। হাড়গোড় সম্পর্কে একটি সত্য ঘটনা রয়েছে। ‘একদিন এক ব্যক্তি শহীদ মিনার বেদীতে এসে একটি খুলি নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। এটি দেখে দায়িত্বরতরা তাকে গতিরোধ করলেন। সোনাগাজী থেকে আসা ওই ব্যক্তি বলছিলেন, খুলিটি আমার ভাইয়ের। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদাররা আমার ভাইকে ধরে এখানে নিয়ে এসেছিল। এরপর আর সে ফিরে যায়নি। আমার ভাইয়ের মাথা বড় ছিল। এ খুলিটি আকারে বড়। এটি আমার ভাইয়ের মাথা।’

মুক্তিযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, একাত্তরে ফেনী কলেজের মাঠ ছিল পাকিস্তানিদের নির্যাতন কেন্দ্র। বিভিন্ন স্থান থেকে স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের ফেনী কলেজে ধরে এনে চালানো হতো অমানুষিক নির্যাতন। এরপর হতভাগ্যদের হত্যা করে কলেজ মাঠে মাটিচাপা দেয়া হতো। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ফেনী পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হলে হাজার-হাজার মানুষ ছুটে আসে কলেজ মাঠে তাদের আত্মীয়- স্বজনের খোঁজে। ফেনী কলেজ মাঠ খুঁড়লে বেরিয়ে আসে অসংখ্য মানুষের হাড়গোড়-খুলি। এই গণকবরে সদ্য নিহত কিছু মানুষের লাশও পাওয়া যায়। এই কলেজ মাঠে কতজন বাঙালিকে হত্যা করে গণকবরে ঠাঁই দেয়া হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা জানা না থাকলেও স্থানীয়দের দাবি ৫ শতাধিক মানুষকে এখানে হত্যা করা হয়েছে।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
error: Content is protected !!