বিনোদন

করোনার তথ্য নিয়ে চীনের লুকোচুরি কেন?

<![CDATA[

চীনের অনেক শহর ও প্রদেশ গত কয়েকদিন ধরেই বলছে, জ্বরে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। দাবি করছে, করোনা ভাইরাস সংক্রমণের চূড়ান্ত পর্যায় পার হয়ে এসেছে তারা। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বলছে অন্য কথা। হাসপাতালগুলো গুরুতর রোগীতে সয়লাব। চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন ডাক্তাররা।

পরিস্থিতি খারাপ বা ভালো দুটোই হতে পারে। যদি ভালো হয়, তাহলে কেন সরকার গত সোমবার (৯ জানুয়ারি) থেকে কোভিড-১৯ সংক্রমণের পরিসংখ্যান ঘোষণা করছে না? বিশ্লেষকরা বলছেন, এর সম্ভাব্য কারণ হচ্ছে, আগামী মার্চ মাসেই চীনা পার্লামেন্ট ন্যাশনাল পিপল’স কংগ্রেসের বার্ষিক বৈঠক বসবে।

বিশ্লেষকদের কারও কারও মতে, ওই বৈঠকের মধ্যদিয়ে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে আনুষ্ঠানিকভাবে আরেক মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট করা হবে। গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক সামনে করে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যাকে রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর বলে মনে করা হচ্ছে। আর তাই হঠাৎ করেই কোভিডের তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

চীনের এই নীরবতা কারও নজর এড়ায়নি। গত বুধবার (১১ জানুয়ারি) বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটি জানায়, জিরো কোভিড নীতি বাতিলের পর চীনে হু হু করে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ।

সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গেব্রেয়াসুস বলেন, প্রতিদিনই আক্রান্ত হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। তবে প্রতিদিন ঠিক কতজন লোক সংক্রমিত হচ্ছে বা করোনায় মারা যাচ্ছে, তা জানা যাচ্ছে না। অভিযোগ, চীন করোনার সঠিক তথ্য দিচ্ছে না। এ কারণে বিশ্বজুড়ে প্রাণহানির পূর্ণাঙ্গ তালিকা পাওয়া যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন: গুপ্তচরবৃত্তি /ইরানের সাবেক উপপ্রতিরক্ষা মন্ত্রীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর

গেব্রেয়াসুস বলেন, চীনকে বারবার করোনা পরিস্থিতি নিয়ে সঠিক ও নির্ভুল তথ্য সরবরাহের কথা বলা হলেও মানছে না দেশটি। এতে বিশ্বজুড়ে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর সঠিক তথ্য তুলে ধরা যাচ্ছে না।

গেব্রেয়াসুস আরও বলেন, ‘গত এক সপ্তাহে কোভিড আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ শতাংশ, ইউরোপ ও পশ্চিম প্রশান্ত অঞ্চলে যথাক্রমে ৩০ শতাংশ। তবে এ তথ্য অসম্পূর্ণ। কারণ, চীনা সরকার এ নিয়ে কোনো সঠিক তথ্য দিচ্ছে না। তাই আমরা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না, গোটা বিশ্বে গেল সপ্তাহে ঠিক কতজন মারা গেছে।’

চীনের প্রতি করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রকাশের আহ্বান জানিয়ে গেব্রেয়াসুস বলেন, ‘চীনের করোনার সঠিক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা উচিৎ। সেই সঙ্গে করোনার কোন ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ছে, নতুন কোনো ভেরিয়েন্ট ছড়ানোর আশঙ্কা আছে কিনা সেসব তথ্যও ভাগাভাগি করা উচিৎ।’

বিষয়টি নিয়ে চীনের নাগরিকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। চলতি সপ্তাহে এপিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে দেশটির স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমার মনে হয় অন্যান্য বিশ্ব ও রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে যথেষ্ট স্বচ্ছতা বজায় রেখে চীনা প্রশাসন তাদের তথ্য আদান-প্রদান করছে। শুধু বহির্বিশ্ব নয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গেও তারা সব তথ্য ভাগাভাগি করছে।’

আরেকজন বলেন, ‘চীনের করোনা তথ্য অন্যের কাছে দেয়ার দরকার আছে বলে মনে হয় না। নিজেদের তথ্য অন্যদের কেন দেব আমরা।’

বিতর্কিত ‘জিরো কোভিড’ নীতি বাতিল

২০২০ সালের শুরুতেই চীনের উহানে করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। চীনের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক সরকারি সংস্থা চায়নিজ সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (চায়না সিডিসি) করোনা তথা কোভিড-১৯ কে ‘বি’ ক্যাটাগরির সংক্রামক রোগ হিসেবে চিহ্নিত করে। তবে একে ‘এ’ ক্যাটাগরির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় মোকাবিলার চেষ্টা করা হয়। যা প্লেগ ও কলেরার মতো মহামারির ক্ষেত্রে করা হয়।

করোনা মহামারির মোকাবিলার ক্ষেত্রে বিতর্কিত ‘জিরো কোভিড’ নীতি ঘোষণা করে বেইজিং এবং স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনের জন্য সেই নীতি মেনে চলার ব্যাপারে ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।

প্রায় তিন বছর ধরে লকডাউন, কোয়ারেন্টাইনসহ বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। গত বছরের শেষ দিকে এসব বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে দেশটির জনগণ। নজিরবিহীন বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের মুখে গত বছরের ৭ ডিসেম্বর সেই ‘শূন্য কোভিড’ নীতি থেকে সরে আসে শি জিনপিং প্রশাসন।

এরপর দেশটিতে আবারও ভাইরাসটির ব্যাপক প্রকোপ শুরু হয়। প্রকোপ বাড়তে থাকায় দেশটির বিভিন্ন হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। শুধু তাই নয়, শেষকৃত্য অনুষ্ঠান স্থলে লাশের দীর্ঘ সারি দেখা যায়।

হঠাৎ করে করোনা সংক্রমণের তথ্য প্রকাশ বন্ধ 

গত রোববার (৮ জানুয়ারি) করোনা ব্যবস্থাপনাকে ‘এ’ ক্যাটাগরি থেকে নামিয়ে ‘বি’ ক্যাটাগরি করা হয় ও সব বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়। পরদিন সোমবার (৯ জানুয়ারি) থেকে করোনা সংক্রমণের তথ্য প্রকাশ বন্ধ করে দেয় দেশটির সরকার।

তবে বিতর্কিত কোভিড নীতি বাতিলের এক মাসেরও বেশি সময় পর শনিবার (১৪ জানুয়ারি) সরকারি স্বাস্থ্য সংস্থা জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন (এনএইচসি) প্রথমবারের মতো করোনায় প্রাণহানির তথ্য প্রকাশ করেছে।

কমিশনের চিকিৎসাবিষয়ক বিভাগের পরিচালক জিয়াও ইয়াহুই বলেছেন, গত ৮ ডিসেম্বর থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত চীনে অন্তত ৬০ হাজার মানুষ করোনায় মারা গেছেন। তিনি জানান, মেডিকেল ইনস্টিটিউটগুলো গত এক মাসের কিছু বেশি সময়ে কোভিড সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে ৫ হাজার ৫০৩ জনের প্রাণহানির তথ্য রেকর্ড করেছে।

জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের তথ্য মতে, যারা মারা গেছেন তাদের গড় বয়স ৮০ দশমিক ৩ বছর। যাদের প্রাণহানি ঘটেছে তাদের ৯০ শতাংশের বয়স ৬৫ বছর বা তার বেশি।

গত মাসে কমিশন ঘোষণা দিয়েছিল, কোভিড-১৯ রোগীদের মধ্যে যারা শ্বাসতন্ত্র বিকল হয়ে মারা যাবেন কেবল তাদের সরকারি করোনায় মৃত্যুর তালিকায় যুক্ত করা হবে। সেই ঘোষণা মতোই শনিবার মৃত্যুর সংখ্যা প্রকাশ করা হলেও আক্রান্তের সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অভিযোগে যা বলছে চীন

মহামারির শুরু থেকে গত ৩ বছর ধরে নিয়মিত করোনার তথ্য প্রকাশ করে আসছিল চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন। তবে গত সপ্তাহে হঠাৎ করেই করোনা সংক্রমণ তথ্য প্রকাশ বন্ধ করা হয়।

এর আগে সবশেষ রোববার (৮ জানুয়ারি) করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করা হয়। চায়না সিডিসির তথ্য মতে, ওইদিন ১৪ হাজার ১৭১ জন আক্রান্ত হয় এবং মাত্র তিনজনের মৃত্যু হয়।

চীন শুরু থেকেই আক্রান্ত ও প্রাণহানির সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করছে না বলে অভিযোগ করে আসছে বিশ্বের কিছু দেশ। গত বুধবার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পক্ষ থেকে বলা হয়, চীন আর করোনা বিষয়ক কোনো তথ্য দিচ্ছে না।

তবে চীনের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কোনো কথা বলা হয়নি। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) বলেন, চীন আইন অনুসারে সময়মত, উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ পদ্ধতিতে প্রাসঙ্গিক তথ্য-উপাত্ত ভাগাভাগি করছে।

আরও পড়ুন: চীনের মোকাবিলায় জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে: কিশিদা

ওয়াং বলেন, কোভিড পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। একই সঙ্গে আমরা প্রযুক্তিগত আদান-প্রদান অব্যাহত রেখেছি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ও সহযোগিতা করছি।

তার কথায় ‘আমরা আশা করি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চীনের কোভিড মোকাবিলার বিষয়টিকে বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিযুক্তভাবে দেখবে ও এ সম্পর্কিত বিবৃতিগুলো বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষভাবে বিচার করবে।’

তবে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, চীনের পক্ষ থেকে আপাতত সরকারিভাবে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করার সম্ভাবনা কম। কারণ বিষয়টি এই মুহূর্তে রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর। বিশেষ করে যখন আর দুই মাস পর আগামী মার্চেই দেশটিতে ন্যাশনাল পিপল’স কংগ্রেসের বার্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।

৯০ কোটি মানুষ করোনা আক্রান্ত

চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত চীনের ৯০ কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের চালানো এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৪ শতাংশ মানুষের শরীরে করোনাভাইরাস রয়েছে।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রদেশভিত্তিক সংক্রমণের ক্ষেত্রে মোট জনসংখ্যার ৯১ শতাংশ সংক্রমণ নিয়ে সবার শীর্ষে রয়েছে গানসু। ৮৪ শতাংশ সংক্রমণ নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ইউনান। এ ছাড়া ৮০ শতাংশ সংক্রমণ নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে কিংহাই প্রদেশ।

চীনা এক শীর্ষ মহামারি বিশেষজ্ঞ সতর্ক করে বলেছেন, দেশটিতে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও, চান্দ্রবর্ষ সামনে রেখে গ্রামীণ অঞ্চলে আবারও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

দেশটির সেন্টার ফর ডিজেস কন্ট্রোলের সাবেক প্রধান ও মহামারি বিশেষজ্ঞ জেং গুয়াং বলেন, চীনের এই করোনা ঢেউয়ের চূড়ান্ত পর্যায় দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত স্থায়ী হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন: মালদ্বীপে নিরাপদ অভিবাসন ও শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের দাবি

আগামী ২৩ জানুয়ারি চীনে লুনার নিউ ইয়ার বা চন্দ্রবর্ষ উদযাপন জমজমাট হবে বলে মনে করছেন অনেকে। এরইমধ্যে রেকর্ড পরিমাণ মানুষ দেশের ভেতর ও বাইরে ভ্রমণ করেছেন।

এছাড়া চন্দ্রবর্ষ শুরুর পর কোটি কোটি চীনা নাগরিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করবে বলেও আশাবাদী কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় করোনার সংক্রমণ যেন না বাড়ে সেজন্য সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

 

]]>

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Check Also
Close
Back to top button
error: Content is protected !!