বাংলাদেশ

আদালতের যুগান্তকারী রায়: সন্তানের অভিভাবক মা

<![CDATA[

বাংলাদেশে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন হাইকোর্ট। এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মাকেও স্বীকৃতি দিয়ে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। ২৪ জানুয়ারি এই বিষয়ে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেন। (ঢাকা পোস্ট, ২৪ জানুয়ারি ২০২৩) এটি একটি যুগান্তকারী রায় হিসেবে গণ্য হতে পারে। এই রায়ের পর সমাজের বড় একটি বঞ্চনার পরিসমাপ্তি হতে পারে বলে আশা করা যায়।

সন্তানের পরিচয় অনিশ্চয়তার দায় বহন করতে হয় মা-কে। সামাজিক এই বঞ্চনা যে কতটা কঠোর তা আমাদের সাহিত্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সেই সময়’ উপন্যাসের একটি অংশ মনে পড়ছে।

উপন্যাসে ১৮৪০-১৮৭০ সালের কথা বলা হয়েছে। সেই সময় জমিদারদের মনোরঞ্জনের জন্য বাইজি রাখা হতো। কখনো বাইজিদের কেউ কেউ গর্ভবতী হতো। এইরকম এক বাইজির ইচ্ছে হলো তার সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাবে।
কর্তৃপক্ষ জানতে চাইলো, সন্তানের বাবা কে? কী তার নাম? বাবার পরিচয় ছাড়া স্কুলে ভর্তি হওয়া যায় না ইত্যাদি ইত্যাদি। বাইজি বিব্রত না হয়ে জানতে চাইল, সত্যিই কি বলবে বাবার নাম ? তাতে ভয় পেয়ে যায় স্কুল কর্তৃপক্ষ। কার না কার নাম বেরিয়ে আসে তখন।

বাবার নাম বলার নিয়ম শুধু সেই সময়ের কলকাতাতেই নয়,বাংলাদেশে চালু ছিল,অন্তত ২৪ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখের আগ পর্যন্ত। আমি বাবার নাম লেখার বিরোধী নই কিন্তু যে সন্তানের বাবার পরিচয় নেই তার কী হবে? সেই ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি মানিকগঞ্জে।

সাংবাদিকতার সুবাদে অনাথ শিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়েছিলাম মানিকগঞ্জে। অসংখ্য অনাথ শিশু একসাথে থাকে। তাদের কারো বাবা নেই,নেই মানে কোথায় আছে কেউ জানে না। সন্তানের মাও জানে না। কারো বাবা পালিয়ে অন্যত্র বিয়ে করেছে। তাই সন্তান এবং স্ত্রী ফেলে গেছে। শিক্ষা কার্যক্রমে তাদের যুক্ত করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল অনাথ আশ্রমের কর্তৃপক্ষের। কারণ তাদের বাবার নাম সন্তানরা জানে না। মাও তাদের বাবার নাম দিতে রাজি নয় কিন্তু শুধুমাত্র নিয়মের কারণে বাবার নাম নিয়ে তাদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছিল।

এই সমস্যা আরও বাড়ছে। এখন বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়েছে। জনশুমারির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা বিবেচনায় বিবাহ বিচ্ছেদের হার (তালাকপ্রাপ্ত) দশমিক ৪২ শতাংশ,… বিধবা বা বিপত্নীকের হার ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ এবং দাম্পত্য বিচ্ছিন্নের হার দশমিক ৩৭ শতাংশ (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ২৭ জুলাই ২০২২)।

বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাকের পর যে নারী সন্তান লালনপালন করছে তাকে কিন্তু না চাইলেও এতদিন সন্তানের বাবার নাম ধারণ করতে হতো। এমনকি বারবার বিবাহ বিচ্ছেদের নথি সাথে রাখতেই হতো। ২৪ জানুয়ারির পর তার আর প্রয়োজন নেই। এইটা আসলে নারীর জয়। যদিও এই জয় সবাই স্বীকার করবে না। কারণ আলোর সাথে হাত ধরাধরি হাঁটে আঁধার। সেই আঁধার নারী বিদ্বেষ, নির্যাতন ও ঘৃণায় ভরা। নির্যাতনের অসংখ্য উদাহরণ আমাদের সামনে আছে।
সমাজে নারীদের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ প্রতিনিয়ত বেড়েই যাচ্ছে। যারা বিদ্বেষী তাদের কোনো যুক্তি নেই। বিভিন্ন অজুহাতে তারা বিদ্বেষ ছড়ায়।  বিদ্বেষের ধরনও কিন্তু হরেকরকম।

আগের যুগের জমিদারদের নারী ভোগের উদাহরণ এখন না থাকলেও  না থাকলেও পিতৃপরিচয়হীন সন্তান এখনও সমাজে রয়ে গেছে। আমাদের সমাজেরই একটি চিত্র ফুটে উঠেছে ভারতীয় একটি চলচ্চিত্রে।  ভারতের একজন যৌনকর্মী গাঙ্গুবাই কাঠিয়াওয়াড়ি। যে কামাঠিপুরা নামের সেই এলাকায় বিপ্লব ঘটিয়েছিল। গাঙ্গুবাই যৌনকর্মীদের সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তাকে নিয়ে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। সঞ্জয় লীলা বানসালি নির্মিত এই চলচ্চিত্র ২০২২ সালে মুক্তি পায়।

এখানেও সেই একই প্রসঙ্গ, যখন গাঙ্গুবাই যৌনকর্মীদের সন্তানদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য স্কুল যায়, স্কুল কর্তৃপক্ষ জানতে চায় বাবার নাম কী হবে? গাঙ্গুবাই বলেছিল, মায়ের নাম কি যথেষ্ট নয়? স্কুল কর্তৃপক্ষ আবারও যখন বাবার নাম জানতে চায় তখন গাঙ্গুবাই বলেছিল, বাবার নাম দেব আনন্দ। যদিও দেব আনানদ একজন চলচ্চিত্র মহাতারকা। গাঙ্গুবাইয়ের এমন উত্তরে সবাই ভড়কে যায়। 

আমাদের দেশেও একজন গাঙ্গুবাই আছে। তার নাম হাজেরা বেগম। হাজেরা একজন যৌনকর্মী। সেই পেশা ছেড়ে যৌনকর্মীদের বাচ্চাদের জন্য গড়ে তোলেন এক আশ্রয়কেন্দ্র। দুইশ’র বেশি পিতৃপরিচয়হীন ছেলে-মেয়ে  আছে হাজেরার আশ্রয়কেন্দ্রে। তাদের বাবা কে? কী পরিচয়? তাদের অধিকার রক্ষায় হাইকোর্টের এই রায় আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।

এই রায় আশীর্বাদ সেইসব নারীদের জন্য যারা একা লড়তে প্রস্তুত। ধর্মান্ধ রক্তচক্ষুকে উপড়ে দিতে প্রস্তুত। তাদের কাছে এখন সন্তানের বাবার পরিচয় বা নাম কোনো বিষয় হয়ে দাঁড়াবে না। স্বাধীন দেশে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মায়ের স্বীকৃতি এক দুর্দান্ত অর্জন।

কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

benoydutta.writer@gmail.com
 

 

]]>

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
error: Content is protected !!