সমর শক্তি নয়, ডলারই সবচেয়ে বড় অস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের
<![CDATA[
১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হন শিল্পোন্নত ১০টি দেশের অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররা। নিজেদের মধ্যে মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা নিয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোই ছিল এ বৈঠকের উদ্দেশ্য।
তখন ছিল অর্থনৈতিক সংকটের কাল। ব্রেটন উডস নামের এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আওতায় একতরফাভাবে মুদ্রার অবমূল্যায়ন না করার যে নীতি এত দিন ধরে পশ্চিমা দেশগুলো অনুসরণ করে আসছিল, অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য তা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন।
তাই ১৯৭১-এর ১৫ আগস্ট একতরফাভাবে ব্রেটনউডস ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। এ ঘটনায় তোলপাড় তৈরি হয় পশ্চিমা দুনিয়ায়। এখনো অর্থনীতির দুনিয়ায় সেই ঘটনাকে স্মরণ করা হয় ‘নিক্সন শক’ নামে।
এর পরপরই নিক্সন প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে বসেন পশ্চিমা শিল্পোন্নত দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীরা। অবশ্য বৈঠক কোনো ফল বয়ে আনেনি। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন নিক্সন। ফলে ভেস্তে যায় ব্রেটন উডস ব্যবস্থা। তবে সেই বৈঠকের একটি উক্তি এখনো বিখ্যাত হয়ে আছে। অন্য অর্থমন্ত্রীরা যখন ডলারের একতরফা অবমূল্যায়নের প্রতিবাদ করেছিলেন, তখন সবার মুখের ওপর নিক্সন প্রশাসনের ট্রেজারি সেক্রেটারি জন কোনালি বলেছিলেন, ইটস আওয়ার কারেন্সি বাট ইটস ইওর প্রবলেম অর্থাৎ এটা আমাদের মুদ্রা, কিন্তু সমস্যাটা তোমাদের।
মূলত তখন থেকেই বাণিজ্যের প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অস্ত্রের নাম ডলার। সেই সত্তরের দশকের মতোই বর্তমানে যখন প্রায় পুরো বিশ্বই অর্থনৈতিক সংকটে, তখন ডলারের একচেটিয়া আধিপত্য যুক্তরাষ্ট্রকে ফের সুযোগ করে দিয়েছে এই অস্ত্র প্রয়োগের। আর এই অস্ত্র প্রয়োগে বিপদে পড়েছে বাকি বিশ্ব। দেশে দেশে কমে যাচ্ছে মুদ্রার মান। তবে ব্যতিক্রম শুধু যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলার। বিশ্ব অর্থনীতির এই টালমাটাল অবস্থার মধ্যেই বাড়ছে ডলারের দাম।
সবচেয়ে সহজে বিনিময়যোগ্য বস্তু মার্কিন ডলার
পৃথিবীতে ডলার সব থেকে বেশি ছাপানো মুদ্রার মধ্যে একটি। তাই ডলার যেকোনো কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে অন্যতম নির্ভরযোগ্য সম্পদ। যেকোনো মুদ্রা, সোনা বা শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধি কিংবা হ্রাস হওয়ার তুলনায় ডলারের মান অনেকটাই স্থিতিশীল।
পুরো পৃথিবীতে অন্য দেশের মুদ্রা এবং পণ্যের লেনদেনে ডলার ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। ডলারের কেনাবেচার বাজার তাই যথেষ্ট সংগঠিত। পৃথিবীর প্রায় সব মানুষই ডলার কেনাবেচা করতে পারেন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের মাধ্যমেই লেনদেন সম্পাদিত হয়। এ কারণে ডলারের আধিপত্য অন্য যেকোনো মুদ্রার চেয়ে বেশি।
অন্য মুদ্রার বিপরীতে ডলারের দাম কমবেশি হওয়ার কারণ
আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো দেশের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও একই সঙ্গে আমদানি ব্যয়ের তুলনায় রফতানি আয় এবং প্রবাসী আয় কমে গেলে সেই দেশের মুদ্রার বিপরীতে ডলারের দাম বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়াও কোনো দেশের কেন্দ্রীয় রিজার্ভের মোট পরিমাণ কমে গেলে, সেখানে ডলারের চাহিদা স্বাভাবিকের চেয়ে ক্রমাগত বাড়তে থাকলে এবং তা সরবরাহে সংকট দেখা দিলে সে দেশের মুদ্রার বিপরীতে ডলারের দাম বৃদ্ধি পায়।
আরও কিছু কারণ রয়েছে যা ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে। যেমন, কোনো দেশে তাদের নিজস্ব নাগরিক বা বিদেশি পর্যটকদের মাধ্যমে নগদ ডলার আসার তুলনায় দেশটির নাগরিকের মাধ্যমে বিদেশে চিকিৎসা, পড়াশোনা কিংবা পর্যটক হিসেবে নগদ ডলার নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়লে, তা সেই দেশের মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে প্রভাব রাখে।
বৈশ্বিক চাহিদার ক্ষেত্রে অনেক সময় ব্যাংক বিভিন্ন অবস্থাভেদে আমদানিকারকদের কাছে উচ্চমূল্যে এবং রফতানিকারকদের কাছে কম মূল্যে ডলার বিক্রি করলেও সে দেশের মুদ্রার মান কমে যেতে পারে। ঠিক এর উল্টো ঘটনা সংঘটিত হলে সেই দেশের মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মান কমে যাবে।
ইউক্রেন যুদ্ধ ডলারের জন্য আশীর্বাদ
কোভিড-১৯-এর সংক্রমণের মুখে ২০২০ সাল থেকেই সারা বিশ্বের অর্থনীতি বিপাকে। ২০২১ সালের শেষে সংক্রমণ কমে এলে শুরু হয় অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের পালা। তবে মহামারির সময় উৎপাদন এবং সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বাড়তে থাকে মুদ্রাস্ফীতির চাপ।
অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার মধ্যেই রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ কোভিডজনিত অর্থনৈতিক সংকটকে আরও ঘনীভূত করে। বিশেষ করে জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল ইউরোপের জন্য ইউক্রেন যুদ্ধ বয়ে আনে দুঃস্বপ্ন। অপরদিকে করোনা প্রতিরোধে শি জিনপিংয়ের নেয়া কঠোর জিরো কোভিড পলিসির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে চীনের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টাও।
চীন আর ইউরোপের অর্থনৈতিক ধাক্কার প্রভাব পড়ে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর ওপরও। কিন্তু এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেও একমাত্র ভালো আছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেন যুদ্ধ তাদের কোনো সমস্যায় ফেলেনি; বরং আশীর্বাদ বয়ে এসেছে তাদের অস্ত্র বাণিজ্য ও জ্বালানি খাতের জন্য। যুদ্ধ শুরুর পর রেকর্ড মুনাফা করেছে তাদের বড় বড় জ্বালানি ও অস্ত্র কোম্পানিগুলো।
ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার বৃদ্ধিও চাঙা করেছে ডলারকে
যুক্তরাষ্ট্রে অস্বস্তি ছিল কেবল মূল্যস্ফীতি নিয়ে। আর এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিজেদের মহার্ঘ অস্ত্র ডলারকে ফের ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় আর্থিক কর্তৃপক্ষ ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক। সম্প্রতি দফায় দফায় সুদের হার বাড়ায় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক, যা গত তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। ফেডারেল রিজার্ভের এই সুদের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্তেই রাতারাতি চাঙা হয় ডলার।
সারা বিশ্বের পুঁজির গন্তব্য এখন যুক্তরাষ্ট্র
ইউরোপ যখন মন্দায়, চীন যখন নিষ্ক্রিয় এবং রাশিয়া যখন নিষেধাজ্ঞায় তখন এই মুহূর্তে বিশ্বে একমাত্র স্থিতিশীল যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি। তার ওপর সুদের হার বাড়িয়ে দেয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ এখন লাভজনক। ফলে বিশ্বের বড় পুজিঁপতিদের সামনে বিনিয়োগের লাভজনক মাধ্যম এখন ডলার এবং বিনিয়োগ গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির মধ্যে সারা বিশ্ব থেকে ডলার ঢুকছে হুহু করে। বিনিয়োগ বাড়ছে মার্কিন শেয়ার ও বন্ডে।
বিশ্বের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাও প্রভাব ফেলছে ডলারের দাম বৃদ্ধিতে
প্রথমে কোভিড, পরবর্তী সময়ে ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্ব অর্থনীতিতে বর্তমানে অনিশ্চিত একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি, ঝুঁকিপূর্ণ ও বড় বিনিয়োগে যেতে চাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। এ ধরনের আপৎকালে সবচেয়ে নিরাপদ স্বর্ণ কিংবা মার্কিন ডলারে বিনিয়োগ করা। কিন্তু বিশ্বে স্বর্ণের জোগান সীমিত, পাশাপাশি স্বর্ণের লেনদেনও কিছুটা ঝক্কির। তাই মার্কিন ডলারের দিকে ঝুঁকছেন বিনিয়োগকারীরা।
২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ডলারের দাম
যুদ্ধের কারণে একদিকে বিশ্ববাজারে প্রায় সব পণ্যের আমদানিমূল্য বেড়ে গেছে, আবার সুদহার বাড়ায় অন্য দেশগুলো থেকে নিরাপদ বিনিয়োগের গন্তব্য হিসেবে পুঁজি ঢুকছে যুক্তরাষ্ট্রে। এই দুইয়ের প্রভাবে প্রায় সব দেশই নিজের মুদ্রাকে অবমূল্যায়ন করতে বাধ্য হচ্ছে। তাই গত ২০ বছরের মধ্যে ডলারের মান এখনই সবচেয়ে বেশি।
দি ইউএস ডলার ইনডেক্স অনুযায়ী, ডলারের বিপরীতে জাপানি ইয়েনের মান কমেছে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, ব্রিটিশ পাউন্ড ও ইউরোর দাম কমেছে সাড়ে ৭ শতাংশ হারে, সুইস ফ্রাঁর মান কমেছে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ আর চীনের মুদ্রা ইউয়ানের অবমূল্যায়ন ঘটেছে সাড়ে ৩ শতাংশ।
এর বাইরে নয় বাংলাদেশও। হঠাৎ করেই গত কয়েক মাসে ডলারের বিপরীতে দফায় দফায় অবমূল্যায়ন ঘটেছে টাকার। সোজা কথায় বললে ডলারের বিপরীতে কমে গেছে টাকার মান।
]]>