ইউরোপের ক্রমবর্ধমান গ্যাসতৃষ্ণা, অন্ধকারে বাংলাদেশ-পাকিস্তান
<![CDATA[
নজিরবিহীন বিদ্যুৎ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। গ্রিড বিপর্যয়ের পর গত এক সপ্তাহেও বিদ্যুৎ পরিস্থিতি আগের লোডশেডিং অবস্থায়ও ফিরতে পারেনি। আগের চেয়ে লোডশেডিং আরও বেড়েছে। আপাতত পরিস্থিতি উন্নতির কোনো আশাও নেই। শুধু বাংলাদেশই নয়, একই পরিস্থিতির মোকাবিলা করছে ভারত-পাকিস্তানসহ বিশ্বের বহু দেশ।
এ পরিস্থিতির অন্যতম প্রধান কারণ ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) অতিরিক্ত চাহিদা। এ মহাদেশের গ্যাসের তীব্র ক্ষুধার কারণেই বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপ রাশিয়ার জ্বালানি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় এ অঞ্চলে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় রফতানি সক্ষমতা বাড়েনি। যার ফলে কিছু দেশ বর্তমানে আগের চেয়ে কম গ্যাস পাচ্ছে।
চলতি বছর তথা ২০২২ সালে আগের বছরগুলোর তুলনায় বেশি পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাস কিনেছে ইউরোপীয় দেশগুলো। ইউক্রেন অভিযানের পর যত দ্রুত সম্ভব রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসতে রীতিমতো দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। ফলে গ্যাসের চাহিদা ও দাম নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। সেই বাড়তি দামেই ব্যাপক পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনেছে ইউরোপীয় দেশগুলো।
জ্বালানিবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ‘ইন্ডিপেনডেন্ট কমোডিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসেস’ (আইসিআইএস) থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র নয় মাসে ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। ফ্রান্সে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় ৮৮ শতাংশ বেড়েছে। নেদারল্যান্ডসে বেড়েছে ১০৯ শতাংশ আর বেলজিয়ামে বেড়েছে ১৫৭ শতাংশ।
আরও পড়ুন: গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে ভর্তুকি দেবে জার্মানি
ইউরোপের এই প্রাকৃতিক গ্যাসের তৃষ্ণা বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের দেশগুলোকে বিপাকে ফেলেছে। একদিকে দাম বেড়েই চলেছে। আরেকদিকে বাজারে জ্বালানির সরবরাহও কম। ফলে বিপদে পড়েছে গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। জ্বালানিবিষয়ক গবেষণা সংস্থা র্যাপিডানের বিশ্লেষক অ্যালেক্স মান্টন বলছেন, ‘অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি অর্থ খরচ করে নিজেদের জন্য বিশাল পরিমাণ জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে ইউরোপের দেশগুলো।’
উন্নত ইউরোপীয় দেশগুলো বেশি দামে প্রাকৃতিক গ্যাস কিনতে পারলেও গরিব দেশগুলোর পক্ষে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে গরিব দেশগুলোকে দামের সঙ্গে চাহিদার সমন্বয় করতে হচ্ছে। আইসিআইএসের পরিসংখ্যান বলছে, ইউরোপের বাইরের দেশগুলোতে, বিশেষ করে এশিয়ায় প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা কমেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২১ সালের তুলনায় চলতি বছর চাহিদা কমেছে ১০ শতাংশ। পাকিস্তানে কমেছে ১৯ শতাংশ আর চীনে ২২ শতাংশ।
নজিরবিহীন বিদ্যুৎ সংকটে বাংলাদেশ
গ্যাস সংকটের মারাত্মক ফল এরই মধ্যে বেশ কিছু দেশে দেখা যাচ্ছে। প্রায় এক দশক পর গত সপ্তাহে সবচেয়ে ভয়াবহ ব্ল্যাকআউটের শিকার হয় বাংলাদেশ, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। কয়েক মাস ধরেই বাংলাদেশ বিশ্ববাজার থেকে পর্যাপ্ত গ্যাস পেতে হিমশিম খাচ্ছে। এ ব্যাপারে ঢাকার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ তামিম বলেন, বাংলাদেশের ব্ল্যাকআউটের প্রধান কারণ জ্বালানির ঘাটতি। তা ছাড়া এর আরও একটি বড় কারণ জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিড আপগ্রেড না করা।
ইউরোপীয় দেশগুলোর কারণে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উল্লেখ করে তামিম বলেন, ‘ইউরোপ যেখানেই পাচ্ছে, সেখান থেকেই গ্যাস কেনার চেষ্টা করছে। তারা বর্তমানে প্রয়োজন পূরণের পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্যও মজুত করছে। আর তাদের ক্রয়ক্ষমতাও উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। তাই স্পষ্টতই,বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলো এতে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
পাকিস্তানও গ্যাস সংকটে
বাংলাদেশের মতো পাকিস্তানও ভয়াবহ জ্বালানি সংকটের কবলে পড়েছে। তারাও কয়েক মাস ধরে বাজার থেকে স্বল্প মেয়াদে গ্যাস কেনার চেষ্টা করছে। তবে এ ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী। গত সপ্তাহেও মাসে মাত্র এক কার্গো গ্যাস সরবরাহের একটি চুক্তি শেষ পর্যন্ত সম্পন্ন করতে পারেননি দেশটির কর্মকর্তারা।
গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের মতো দেশগুলো যে সমস্যাগুলো মোকাবিলা করছে, তার মধ্যে অন্যতম বড় সমস্যা হলো সরবরাহকারীদের সঙ্গে স্বাক্ষর করা চুক্তির ধরন। যেসব বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে পাকিস্তান চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যেগুলো নিজেরা প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন করতে পারে না।
এমনকি এসব সংস্থার সঙ্গে করা চুক্তিতে প্রায়ই ব্রেক ক্লজ অন্তর্ভুক্ত থাকে। এর অর্থ, সরবরাহকারীরা স্বল্প নোটিশে চাইলে অন্যদের কাছেও গ্যাস বিক্রি করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে তাদের কিছু জরিমানা গুনতে হয়।
আরও পড়ুন: তেল-গ্যাসের সন্ধানে মরিয়া পশ্চিমারা
কিন্তু সংস্থাগুলো যদি অন্যদের কাছে বেশি দামে এলএনজি বিক্রি করতে পারে, তাহলে তারা সহজেই জরিমানা দিয়ে পাকিস্তানের মতো দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে ফেলে। এমনকি জরিমানা দেয়ার পর তারা যথেষ্ট লাভও করতে পারে। পর্যাপ্ত জ্বালানি কিনতে পাকিস্তানের এই অক্ষমতার অর্থ হলো, বিদ্যুৎ ঘাটতি দেশে দীর্ঘমেয়াদি রূপ নিতে পারে।
মান্টনের মতে, বিশ্বব্যাপী এলএনজি বাজারের চাপ শিগগিরই শেষ হবে না। তার ভাষায়: ‘যদি ইউরোপের মতো দেশগুলোর হঠাৎ করে আরও এলএনজির প্রয়োজন হয়, তাহলে তারা কিন্তু মোট সরবরাহ বাড়াতে পারবে না। তারা কেবল বর্তমানে মজুত করা এলএনজি থেকেই বাণিজ্য করতে পারবে।’
বাংলাদেশের সবশেষ পরিস্থিতি
গ্রিড বিপর্যয়ের পর এক সপ্তাহেও বাংলাদেশে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি আগের লোডশেডিং অবস্থায়ও ফিরতে পারেনি। আগের চেয়ে লোডশেডিং আরও বেড়েছে। আর আপাতত এই পরিস্থিতির উন্নতির কোনো আশাও নেই।
মঙ্গলবার (১১ অক্টোবর) বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নিজেই বলেছেন, ‘মধ্যরাতেও লোডশেডিংনিয়ে আপাতত বিছু করার নেই। সবাইকে আরও একটু কষ্ট করতে হবে। জ্বালানি তেল ও গ্যাস সংকটের কারণে বিদুৎকেন্দ্রগুলো চালানো যাচ্ছে না।’
বাংলাদেশের ১৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ৬৩টি এখন জ্বালানির অভাবে বসে আছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী পরিস্থিতি এখন অনেকটা প্রকৃতির ওপরই ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘শীত এলে বিদ্যুতের চাহিদা কমবে। তখন হয়তো কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যাবে।’
]]>