Feni (ফেনী)উপ-সম্পাদকীয়

দুনীতিমুক্ত প্রশাসন এই প্রবাদে চলছে বাংলাদেশ

নাজমুল হক

বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট নাগরিকের দেশ। এদেশে সাড়ে তিন লক্ষাধিক মসজিদ ও মক্তব আছে। মসজিদের আজান শুনা যায়না এমন একটি গ্রামও নেই। দশ হাজারের অধিক দাখিল আলিম ও কামিল মাদরাসা আছে। সাড়ে ছয় হাজারের অধিক কওমী মাদরাসা আছে। প্রতিবছর লক্ষাধিক নারী ও পুরুষ হজ্জ ও উমরাহ পালন করে। প্রতিটি মসজিদে তাবলীগ জামাত এর গা শত আছে। জেলা ও উপজেলায় মাজার আছে, খানকা আছে, লক্ষ লক্ষ হাফেজ কারী মুফতি মাওলানা সাহেব আছে। প্রতিটি মসজিদে ইমাম ও মুয়াজ্জিন আছে, ইয়াতিম খানা আছে। যাকাত ও ওশর দানকারী আছে, ইসলামী ব্যাংক আছে। ইসলামী বীমা আছে। ইসলামীক ফাউন্ডেশন আছে, হেফজখানা আছে, নুরানি মাদরাসা আছে, যাকাত বোড আছে। বিভিন্ন ধমীয় রাজনৈতিক দল আছে। ওয়াজ মাহফিলে আছে। মাজারে ওরশ আছে। বিশ্ব ইজতেমা আছে। মেজবান আছে, ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি এনজিও এবং শিল্প গ্রুপের শরীয়া বোড আছে। শিশু ও নারীর হিজাব পরিধান করে চলাচল অব্যাহত আছে, লাশ দাফনের সময় ইসলাম ধর্ম মোতাবেক দাফন কাফনের ব্যবস্থা আছে। তাসবীয় টিপার লোক আছে, মসজিদে জিকির দুআ আছে। আবার বিভিন্ন দফতর ও অফিসে ঘুষ বানিজ্য অব্যাহত আছে। রেলপথ মন্ত্রনালয়ে কালো বিড়াল দুনীতি আছে, স্বাস্থ্যসেবা খাতে দুনীতি আছে, নিয়োগ বানিজ্য আছে, তারপরও ঘুষখোর ও দুনীতি বদনাম শুধুমাত্র পুলিশ সদস্যদের।

ডিজিটাল বাংলাদেশ এনআইডি ছাড়া শিক্ষা ও চাকুরী ব্যবসা বানিজ্যে এবং পাসপোর্ট তৈরি এবং জমি রেজিষ্ট্রেশন, ট্রেড লাইসেন্স, ড্রাইভিং লাইসেন্স করা যায় না। এখন নতুন সংযোজন ছেলে-মেয়ের স্কুল ও মাদরাসায় ভতির জন্য পিতা মাতার জন্ম নিবন্ধন করা বাধ্যতামুলক। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সাহেবের আইসিটি বিভাগ ডিজিটাল বাংলাদেশের ঘুষ বানিজ্য ও নাগরিক হয়রানীর কেন্দ্রবিন্দু। পিতা-মাতা মারা গেলে ওয়ারিশ সনদ, নাগরিকত্ব সনদ, জন্ম নিবন্ধন, নাম ও ঠিকানা সংশোধন ইত্যাদির জন্য আপনাকে টাকা দিতেই হবে। এই কাজটি পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশন করে থাকে, সেখানেও টাকা ছাড়া কোন নাগরিক সেবা নেই।

জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তে পিতার নামে ভুল, মাতার নামে ভুল, স্ত্রীর নামে ভুল, গ্রামের নামে ভুল, ওয়ার্ডের নামে ভুল করে বসে আছে নিবাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তারা। এখন টাকা ছাড়া কোন কিছু অনলাইনে সংশোধন করা যাবে না। এই কাজের জন্য একটা শ্রেণির টাকার বিশাল বানিজ্য চলছে। নাগরিক হয়রানীর কেন্দ্র বিন্দু জাতীয় পরিচয়পত্রের দফতর। এখানেতো পুলিশ নেই, তাহলে টাকা নিচ্ছে যারা তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না কেন।

প্রতিটি ইউনিয়নে ভুমি অফিস আছে, জমির নামজারী জমির নকল উঠানো, খাজনা প্রদান ইত্যাদি কাজ করতে হলে পকেট থেকে অতিরিক্ত টাকা ঢালতেই হবে। ভুমি জরীপকালে দাগ নাম্বার, পিতার নাম, জমির পরিমান ইত্যাদিতে ভুল লেগেই আছে। এই ধরনের ভুল সংশোধন করতে হলে আইন আদালতে যেতে হবে এখনেও টাকা আর টাকা এবং হয়রানীর শিকার হতে হবে। জমি ক্রয় বিক্রয়কালেও সাব-রেজিষ্ট্রেশন অফিসকে অতিরিক্ত টাকা দিতে হবে। এখানেও কি পুলিশ ঘুষ বানিজ্য করে। কে এর জবাব দেবে।

গ্যাস বিদ্যুৎ পানি খাজনা, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স ও আয়কর বিভাগ ইত্যাদি দফতর টাকা ছাড়া কোথাও কোন ফ্রী সার্ভিস নেই। টাকা ছাড়া নাম সংশোধন করা যাবে না। কোন সংযোগ পাওয়া যাবে না। এখানে পুলিশ সদস্য কি ঘুষ বানিজ্য করে ?

পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত বিজেএমইএ, বিকেএমইএ, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স, ফায়ার সার্ভিস, সিএন্ডএফ, বিমানবন্দর এবং

সামুদ্রিক বন্দর ইত্যাদি দফতরে টাকা ছাড়া কোন উপায় নেই। অতিরিক্ত টাকা ছাড়া পণ্য রপ্তানি বানিজ্যে ও আমদানি বানিজ্য হবে না।
বিদেশ ভ্রমণ, বিদেশে শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য, হজ্জ উমরাহ পালন, অভিবাসনের জন্য পাসপোর্ট তৈরি করতে হবে। এই পাসপোর্ট পাইতে হলে পুলিশ ভেরিফাই রিপোর্ট লাগবে এবং পাসপোর্ট অফিসের দালাল লাগবে টাকা ছাড়া মুক্তি পাওয়া যাবে না।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য শতাধিক দেশী ও বিদেশি উন্নয়ন সংস্থা আছে, সেখানে খাদ্য সামগ্রী ও অন্যান্য সামগ্রী বন্টনের জন্য সরকারী অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সেখানেও টাকা ছাড়া কোন সেবা নেই। কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিসে ব্যানার ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে “আমি ও আমার দফতর ঘুষ ও দুর্নীতি মুক্ত” সেখানে টাকা ছাড়া হেলথ ক্যাম্পের অনুমোদন পাওয়া যায় না। বিদেশি ফান্ড নিয়ে কাজ করবেন এফডি-৬ অনুমোদন নিতে হলে অতিরিক্ত সেলামী দিয়ে আসতে হবে। সেলামী ছাড়া কোন উপায় নেই। সেখানে কোন পোশাকধারী পুলিশ নেই। তাহলে ঘুষের সাথে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনবে কে?

আপনি শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবী স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন, শিক্ষার্থীদের পাঠ পরিকল্পনা অনুমোদন ৮ম শ্রেণির অনুমোদন, দশম শ্রেণির অনুমোদন, এমপিওভুক্তি ইত্যাদি বাবদ অর্থ ব্যয় করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিদশন কর্মকর্তাদের যাতায়াত ও সম্মানী দিতে হবে। সরকারী ভবন পাইতে হলেও টাকা দিতে হবে। টাকা ঢালা ছাড়া কোন উপায় নেই।
বাংলাদেশে যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিল্ডিং তৈরি করে, রাস্তা তৈরি করে, ব্রিজ তৈরি করে, তারাই জানে কোথায় কিভাবে ঘুষ বানিজ্য চলে এবং কাহারা ঘুষখোর ও দুনীতিবাজ। কোন কোন সরকারী কর্মকর্তা ঘুষ ও দুনীতি করে লুটপাট করে টাকার মালিক হয়েছে।
সারাজীবন চাকুরীতে ঘুষ বানিজ্য করে ছিলেন এখন পেনশনের ফাইল পাশ করাবেন সেখানেও ঘুষ দিয়ে মুক্তি পাবেন। যারা ঘুষখোর ও দুনীতি করে লুটপাট করে টাকার মালিক তারাই মসজিদ মাদরাসা সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করে। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। জাতীয় শুদ্ধাচার কমিশন নেই।
ফেসবুক ফেইজ থেকে পাওয়া গল্প পুলিশ ঘুষ খায়, আমি ব্যবসায়ী আমি ঘুষ খাই না, আমি ৫ টাকার মাক্স ১০০ টাকায় বিক্রি করি। আমি শিক্ষক আমি ঘুষ খাইনা, আমার নিকট যে সকল ছাত্র-ছাত্রী প্রাইভেট পরবে আমি তাকে পরীক্ষায় পাশ করে দেই। আমি ডাক্তার আমি ঘুষ খাইনা, আমি একজন মাকে নরমাল ডেলিভারি না করে ভয় দেখিয়ে বেশি টাকার জন্য সিজারের পরামর্শ দেই। আমি উকিল আমি ঘুষ খাইনা, আমি টাকার জন্য একজন ধর্ষকের পক্ষে উকালতি করি। আমি সাধারণ জনগন আমি ঘুষ খাইনা, আমি কিছু টাকার জন্য নিজের মূল্যবান ভোটটা একজন নেতার কাছে বিক্রি করে দেই। সব শেষে পুলিশ ঘুষ খায়।

এভাবেই তৈরি হচ্ছে ধনীদের রাজ্য ও ধনীক শ্রেণি। বেগম পাড়া। দেশে কিভাবে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান কমবে। মাদক চোরাচালান হুন্ডির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, মজুতদার সিন্ডিকেট থেকে কিভাবে জাতি মুক্তি পাবেন। জন্মনিবন্ধন ও ভোটার আইডি কার্ড এবং ভুমি অফিসের খাজনা দিয়ে ঘুষের সাথে ১৬.৫ কোটি নাগরিকদের জীবন শুরু। কিভাবে এই জাতিকে ঘুষখোর ও দুনীতিবাজদের থেকে মুক্তি দেওয়া যাবে। জীবনের কোন স্তরে ঘুষ দিতে হয়নি এবং ঘুষখোরের সাথে দেখা হয়নি এমন নাগরিক কি পাওয়া যাবে।

লেখক : গবেষক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
error: Content is protected !!