পাহাড়ের অফুরান সম্ভাবনা কবে কাজে লাগাতে পারবে বাংলাদেশ?
<![CDATA[
পাহাড় শব্দটি উচ্চারিত হলেই মানসপটে ভেসে ওঠে বান্দরবানের সাজেক, রাঙামাটির কাপ্তাই ও খাগড়াছড়ির ভ্যালিগুলো। কিন্তু পাহাড় মানেই কি সামষ্টিক কিছু দর্শনীয় জায়গা, নাকি অন্য কিছু?
দেশের আয়তনের ১০ ভাগের ১ ভাগজুড়ে রয়েছে ১৩ হাজার ১৮৪ বর্গকিলোমিটারের পার্বত্য এলাকা। প্রায় ১৭টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও সেটেলার বাঙালি মিলিয়ে পার্বত্য এলাকার জনসংখ্যা প্রায় ১০ লাখ ৫০ হাজার।
পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসী সন্ত্রাসীগোষ্ঠী ও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাতের ঘটনা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এতসব সংঘাত ও সাদা চোখে দেখা দর্শনীয় জায়গা ছাড়াও পাহাড়ের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে অমিত সম্ভাবনা। বিশেষ করে পাহাড়ের কৃষিব্যবস্থা বদলে দিতে পারে গোটা বাংলাদেশের চিত্র–এমনটাই বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
ধান-গম ছাড়াও পাহাড়ে চাষ হয় নানা ধরনের মৌসুমি ফল, উচ্চ দামের মসলা ও রাবার। বাংলাদেশ কৃষি অধিদফতরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে ৫৬ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ হয় ও ৯৮ হাজার হেক্টর জমিতে উদ্যান ফসলের চাষাবাদ হয়ে থাকে।
খাগড়াছড়ি কৃষি অধিদফতরের তথ্য থেকে দেখা যায়, কেবল এক জেলায়ই বছরে এক হাজার কোটি টাকা মূল্যের কৃষিপণ্য বাজারজাত করা হয়ে থাকে। খাগড়াছড়ির পাশাপাশি রাঙামাটি ও বান্দরবানেও প্রায় সমমূল্যের কৃষিপণ্য বেচাকেনা হয়।
স্থানীয় কৃষি অফিসগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পার্বত্য অঞ্চলগুলো দিনকে দিন কমলা, মাল্টা ও ড্রাগন চাষে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠছে। এ ছাড়াও মসলার মধ্যে হলুদ, দারুচিনি ও এলাচ চাষের জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এসব চাষাবাদের বাইরেও এখনও পাহাড়ে ৫ লাখ হেক্টর জমি অনাবাদি পড়ে আছে, যেখান থেকে নির্দিষ্ট ফসল চাষ করে বছরে ১৭ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের (এআইএস) প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, পাহাড়ি ঢালে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের জন্য ভালো কলা, আনারস, মাল্টা, কমলা, পেঁপে, আম ও কাঁঠাল। এ ছাড়া রাম্বুটান, ড্রাগন ফল, প্যাসন ফল, স্ট্রবেরি, কাজুবাদামের মতো বিদেশি ফলেরও উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।
আরও পড়ুন: সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশের বাঁচার উপায় কী?
উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য শুধু ফল নয়, ফলের জাত নির্বাচনে গুরুত্ব দিতে হবে। যেমন, আগাম জাত বারি আম ৫ ও নাবি জাত বারি আম ৪ জাতের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে আম প্রাপ্তির সময়কালকে দীর্ঘায়িত করা যেতে পারে। স্থানীয় জাতের পরিবর্তে যদি উন্নত জাতের ‘বারি কাঁঠাল ৩’ সম্প্রসারণ করা যায়, তাহলে ফলন বাড়তে পারে ৩-৪ গুণ, অসময়েও কাঁঠাল উৎপাদন করে অধিক লাভবান হওয়া যেতে পারে। তেমনি কলা চাষেও আধুনিক জাতের ব্যবহার করা উচিত। বাংলা কলা পাহাড়ে খুব পরিচিত ও জনপ্রিয় জাত। এ জাতের উন্নয়ন ঘটিয়ে উদ্ভাবন করা হয়েছে বারি কলা ৩ জাত। এ জাতের কলা চাষ করে হেক্টরপ্রতি ৪০-৫০ টন কলা পাওয়া যেতে পারে, যা পাহাড়ে কলা চাষের উৎপাদন বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে বলে জানিয়েছে এআইএস।
এআইএসের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মৃত্যুঞ্জয় রায় কৃষিকথার বিশেষ সংখ্যায় পাহাড়ে ফলন বাড়ানোর ব্যাপারে বলেন, পাহাড়ে লাগানো ফলগাছগুলোর আধুনিক নিয়মে ব্যবস্থাপনা করা দরকার। পাশাপাশি উন্নত পদ্ধতিতে ফলগাছ লাগানো ও তার যত্ন নেয়া দরকার। এরই মধ্যে সেখানে যেসব আমগাছ লাগানো হয়েছে তার অধিকাংশই খুব ঘন করে লাগানো। এসব বাগানের গাছ কিছু সরিয়ে পাতলা করা উচিত। পাহাড়ে ফলগাছে সেচ দেয়া এক অন্যতম প্রধান সমস্যা। পাহাড়ে যে বছর এপ্রিলে কম বৃষ্টি হয় বা হয় না, সে বছর আম, লিচু ইত্যাদি ফল ঝরা বেড়ে যায়। ক্রমাগতভাবে পাহাড়ি বন উজাড়ের ফলে বৃষ্টি কম হয় ও পাহাড়ের ঝিরিসমূহে পানির সঞ্চয় থাকে না। ফলে ঝিরি বা পাহাড়ের খাদে জমা জলাশয়ের পানি থেকে পাম্প করে ফলগাছে সেচ দেয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে অল্প পানি থাকলেও ড্রিপ সেচ পদ্ধতিতে ফলগাছের গোড়ায় সেচ দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, রোগ ও পোকা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা কৌশল অবলম্বন করা দরকার। আম ও অন্যান্য ফলে ফ্রুট ব্যাগিং করা যেতে পারে। আম ও পেয়ারায় সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করা যায়। সারা বছর ধরে আনারস উৎপাদনের জন্য হরমোন ব্যবহারসহ অন্যান্য ব্যবস্থাপনার কাজ করা যেতে পারে। অসময়ে ফলানো আনারসের দাম বেশি পাওয়ায় তা পাহাড়ি কৃষকদের আয় বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে। ফলের প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তুলতে হবে এবং সেখান থেকে দেশের সব জায়গায় বিক্রির ব্যবস্থা বা নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। বান্দরবান ও রাঙামাটিতে কাজুবাদাম চাষের ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের বর্তমান অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। কাজুবাদাম দামি ফল। একে প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করলে লাভ বেশি হতে পারে। এ আশায় রাঙামাটিতে প্রক্রিয়াজাত শিল্প স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু সারা বছর সেখানে কাঁচামাল পাওয়া যায় না। তাহলে সে কারখানার শ্রমিকদের কীভাবে ধরে রাখা যাবে, শিল্প সচল কীভাবে থাকবে? তাই শিল্প স্থাপনে সেটা সারা বছর যাতে সচল থাকে–এমন বিবেচনা ও পরিকল্পনা করতে হবে।
ফলগাছ থেকে শুধু ফল সংগ্রহ নয়, গাছের বহুমুখী ব্যবহারের দিকেও নজর দেয়া যেতে পারে। যেমন, আনারস গাছের পাতা থেকে আঁশ উৎপাদন করে তা থেকে রশি বানানো ও বস্ত্র বয়ন, বিভিন্ন ক্র্যাফট সামগ্রী তৈরি করা যায়। অথচ আনারসের পাতা ফেলে দেয়া হয়। ফলের উপযুক্ত বাজার ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড় থেকে বাজারে ফল আনার জন্য যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ, সংগৃহীত ফল বিক্রির পূর্বপর্যন্ত তার সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সংগ্রহোত্তর অপচয় কমানো, সংরক্ষণ বা মজুতের যথাযথ সুবিধা গড়ে তোলা ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া দরকার বলে জানান মৃত্যুঞ্জয় রায়।
]]>