মিরসরাইয়ে বালুর ড্রেজার ডুবে সাগরে ৮ শ্রমিক নিখোঁজ
মিরসরাই প্রতিনিধিঃ
চট্টগ্রামের মিরসরাই উপকূলের স›দ্বীপ চ্যানেলে বালু তোলার ড্রেজার ডুবে আট শ্রমিক নিখোঁজ রযেছে। ঘটনার ২৪ ঘন্টা পরও তাদের উদ্ধার করা যায়নি। ধারনা করা হচ্ছে তাদের সবাই মারা গেছে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সোমবার রাত ৮টার দিকে উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের বসুন্ধরার ৩ নম্বর জেটি এলাকার পশ্চিমে এ ড্রেজারডুবির ঘটনা ঘটে। নিখোঁজ হওয়ার পর মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত তাদের সন্ধান মেলেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বসুন্ধরা ৩নং এলাকায় বেড়িবাঁধ থেকে ৫০০ ফুট দূরত্বে সাগরের মাঝে সৈকত এন্টারপ্রাইজ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বালু উত্তোলনের ড্রেজার মেশিন সৈকত-২ ছিলো। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বালু সরবরাহের কাছ করছিলো। তারা উপ-ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান খোকন কনষ্ট্রাকশনের জন্য বালু উত্তোলন করেছিলেন মো. গাফফারের মালিকানাধীন সৈকত এন্টারপ্রাইজের ড্রেজার। মঙ্গলবার দুপুর ২টায় চট্টগ্রাম শহর থেকে আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের ৮ সদস্যের ডুবুরি দল উদ্ধার অভিযান শুরু করেছেন। নিখোঁজ শ্রমিকদের লাশের জন্য সাগরপাড়ে অপেক্ষা করছেন স্বজনরা। কিন্তু সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত তাদের নিখোঁজ শ্রমিকদের লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
ড্রেজারে অবস্থানরত নিখোঁজ শ্রমিকরা হলো শাহীন মোল্লা (৩৮), ড্রেজার চালক ইমাম মোল্লা (৩২) তারা আপন দুই ভাই। এছাড়াও মাহমুদ মোল্লা (৩২), আলামিন (২১), তারেক (২৬), আবুল বশর (৪৫) ও আরো অজ্ঞাত দুইজন নিখোঁজ হন। সকলের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার সদরের জৈনকাঠি ইউনিয়নে। এদিকে মঙ্গলবার সকাল থেকে ঘটনাস্থলে অবস্থান করছেন মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিনহাজুর রহমান, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মিজানুর রহমান, মিরসরাই থানার অফিসার ইনচার্জ মো. কবির হোসেন।
ড্রেজার মেশিন সৈকত-২ এর ব্যবস্থাপক মো.রেজাউল করিম জানান, ঘটনাস্থলে আরো ৬টি ড্রেজার রাখা ছিল। সতর্কতা সংকেত পেয়ে অপরাপর সকল শ্রমিক নিরাপদ স্থানে চলে গেলেও সমুদ্রে ঢেউ বেশী থাকায় আমাদের শ্রমিকদের আনার জন্য নৌকা ড্রেজারের কাছে যেতে পারেনি। শ্রমিকদের উদ্ধারের জন্য ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
নিখোঁজ শাহিন মোল্লা ও ইমাম মোল্লার মেঝ ভাই এনায়েত উল্লাহ বলেন, গতকাল রাত সাড়ে ৮ টা থেকে আমার আপন দুই ভাই ও অপর চাচাতো-জেঠাতো ৬ ভাই মোট ৮জন বালু উত্তোলনের ড্রেজারে সাগরে আটকে পড়ে। রাতে বিষয়টি শুনার পর তাৎক্ষণিক রওনা দিয়ে সকাল ১০ টা ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখি উদ্ধার তৎপরতা চোখে পড়েনি দেখে আমরা হতাশ হয়। উদ্ধারকারি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে দুপুর ২টার দিকে। সাড়ে ২৪ ঘন্টার পার হয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত আমার ভাইদের লাশ খুঁজে পাইনি। আমি মনে করছি এখানে প্রশাসনের গাফিলতি রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ঘটনার পর ড্রেজার সৈকত-২ মালিক মো. গাফফারকে রাতে ফোন দিলে তিনি বলেন, আমি অসুস্থ হাসপাতালে তুমি যাও, আমি সকালে আসবো। সকালে এসে তাকে একাধিক বার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এদিকে মঙ্গলবার সকাল থেকে স্বজনের খোঁজে সাগর পাড়ে সারাদিন অপেক্ষা করেন স্বজনরা। তাদের একজন জামাল উদ্দিন বলেন, মাহমুদ মোল্লা নামে নিখোঁজ হওয়া শ্রমিক আমার সালা। অন্য শ্রমিকরাও একই এলাকার। গতকাল রাতে তারা সাগরে নিখোঁজ হওয়ার খবর শুনে রাতে এখানে আসার জন্য বাস কাউন্টারে গেলেও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে রাতে রওয়ানা দিতে পারিনি। ভোর রাতে রওয়ানা দিয়ে দুপুরে এসে এখানে এসে পৌছায়। কিন্তু তখনও উদ্ধার অভিযান চোখে পড়েনি।
আরেক স্বজন মহিউদ্দিন বলেন, আমরা তো আর তাদের জীবন ফিরে পাবো না। অন্তত লাশ হলেও পেতে চাই। লাশ পেলেও নিজের মনকে বুঝাতে পারবো।
এছাড়া ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এর প্রভাবে বসুন্ধরা পয়েন্ট আরো প্রায় ২০টি ইঞ্জিনচালিত বোর্ট ভেঙ্গে গেছে। ক্ষতিগ্রস্থরা মালিকরা হলেন আলতাফ হোসেন, শওকত হোসেন, সুরেশ চন্দ্র জলদাশ, ভোটন জলদাশ ১১ জনের ২০টি ভোট ভেঙ্গে সাগরের পানিতে ভেসে গেছে। এতে প্রায় কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবী করেন বোট মালিক শওকত হোসেন।
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জিহান বিল্ডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ঘূর্ণিঝড় সাত্রাং এর প্রভাবে আমার বালু উত্তোলনে ব্যবহত বেশ কয়েকটি পাইপ সাগরে ভেসে গেছে। এতে আমার কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি হয়।
ড্রেজার থেকে বেঁচে ফেরা শ্রমিক মো. সালাম জানান, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে তীব্র বাতাস ও ঢেউ ওঠায় সৈকত-২ নামে তাদের ড্রেজারটি মিরসরাই উপকূলের স›দ্বীপ চ্যানেলে ডুবে যায়। ড্রেজারটির মালিক সৈকত এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে নিয়োগ দিয়েছে বেপজা। ড্রেজারটিতে থাকা ৯ শ্রমিকের মধ্যে তিনি কিনারে আসতে পারলেও বাকি ৮ শ্রমিক আটকা পড়েন।
স্থানীয় বাসিন্দা বেলাল হোসেন বলেন, মঙ্গলবার ভোরে ড্রেজারের ভিতরে আটকে পড়া শ্রমিকদের পাঁ দেখা গেছে। তখন ড্রেজারটি আরও কিনারে (কাছে) ছিলো। ড্রেজারটি ঘটনাস্থল থেকে একটু দূরে চলে গেছে। আমরা একাধিকবার কোর্স্ট গার্ডকে ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেন নাই। তারা যদি সময়মতো আসতো তাহলে এতো বড় দূর্ঘটনা ঘটতো না।
তবে বিষয়টি অস্বিকার করেছেন কোস্ট গার্ড কমান্ডার জহিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমরা খবরটি শুনার সাথে সাথে ঘটনাস্থলে ছুটে আসি। নেট সমস্যার কারনে একটু বিলম্ভ হয়েছে।
চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের ডুবরী দলের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ হারুন পাশা বলেন, আমাদের ৮ জন ডুবরী দুপুর ২টা থেকে উদ্ধার অভিযান শুরু হয়েছে। সাগরে একটু স্রোত বেশি থাকায় উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না এখনো পর্যন্ত আসা করি সাগরে স্রোত কমে গেলে দ্রুত তাদের উদ্ধার করতে সক্ষম হবো।
সাহেরখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুল হায়দার চৌধুরী বলেন, আমার ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের বসুন্ধরা পয়েন্টে বালু উত্তোলন কাজে নিয়োজত একটি ড্রেজারের ৮ শ্রমিক সহ নিখোঁজ হওয়ার বিষয় শুনেছি। সোমবার বিকেলে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে সবাইকে সতর্ক অবস্থানে চলে যেতে মাইকিং করা হয়েছে। তারপরও তারা কেন নিরাপদ আশ্রয়ে গেলো না বুঝতে পারছিনা। অসাবধানতার কারণে এভাবে শ্রমিক গুলো হারিয়ে গেলো।
মিরসরাই থানার অফিসার ইনচার্জ মো. কবির হোসেন বলেন, সাগরে ড্রেজার সহ ৮ শ্রমিক নিখোঁজের খবর পেয়ে আমরা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আসি। সংশ্লিষ্ট কোস্ট গার্ড কমান্ডার কে বিষয়টি মোবাইলে অবগত করে তাদের কোন সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। পরে ফায়ার সার্ভিসকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে।
মিরসরাই ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের কর্মকর্তা ইমাম হোসেন পাটোয়ারি বলেন, মঙ্গলবার সকাল আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছি। দুপুর ২টার দিকে চট্টগ্রাম থেকে আসা ৮ সদস্যের একটি ডুবুরি দল উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কাউকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তিনি আরও বলেন, বালু ভর্তি ড্রেজারটি উল্টে দরজা বন্ধ থাকায় উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। ড্রেজারটি উদ্ধারের জন্য একটি ট্রলারের প্রয়োজন। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখছি, কোথায় উদ্ধার ট্রলার পাওয়া যায়।
মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মিনহাজুর রহমান বলেন, দুপুর ২ টায় চট্টগ্রাম শহর থেকে আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের ৮ সদস্যের একটি ডুবরী দল উদ্ধার অভিযানে নেমেছে। তবে দুপুরে সাগরে জোয়ার থাকায় উদ্ধার অভিযানে ব্যাহত হলেও বিকেল থেকে আবার পুনরায় উদ্ধর অভিযান শুরু হয়েছে। ড্রেজারটির দরজা গুলো লোহার দরজা হওয়ায় উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছেনা। নিখোঁজ শ্রমিকদের না পাওয়া পর্যন্ত রাতেও উদ্ধার অভিযান অব্যাহত থাকবে।